চট্টগ্রামের সাহিত্য ও ইতিহাস গবেষণায় ইসহাক চৌধুরীর অবদান

164

আমার বন্ধু, সহপাঠী, পুঁথি বিশারদ ইসহাক চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে লিখতে যেয়ে আমি সাহস করে যে কথা বলতে পারিনি, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. মনিরুজ্জামান স্যার সে কথা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। তিনি দৈনিক আজাদীতে লেখা তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন-“ইসহাক চৌধুরী : চট্টগ্রামের প্রাচীন ও লোক সাহিত্যের শেষ গবেষক।” একথাটিই হয়তো আমি বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার সাহস হয়নি, কারণ সে কথা বলার অথরিটি আমার ছিলো না, স্যার বলতে পেরেছেন, কারণ তাঁর সে অথরিটি আছে।
মনিরুজ্জামান স্যার সত্য কথাই বলেছেন। সত্যিই তো চট্টগ্রামের প্রাচীন ও লোক সাহিত্যের শেষ গবেষকই ছিলেন ইসহাক চৌধুরী। চট্টগ্রামের প্রাচীন সাহিত্য মানে পুঁথি সাহিত্য। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রচিত চর্যা ও দোহা যা নেপালের রাজদরবার থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় উদ্ধার করে এনেছিলেন, তারপরে ভারতচন্দ্র বা কিঞ্চিৎ পরবর্তী ঈশ্বর গুপ্ত পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য ছিলো ফাঁকা। সেজন্য সাহিত্যের যুগ বিভাগ করতে গিয়ে ইতিহাস রচয়িতারা উক্ত সময়টাকে ‘অন্ধকার যুগ’ নামে অভিহিত করেছেন। বহুদিন এই শূন্যতাকে মেনে নিয়ে সাহিত্যের পঠন-পাঠন হতো। তারপর পটিয়ার সুচক্রদন্ডী গ্রামে আবদুল করিম নামে একজন মহাপুরুষের জন্ম হলো, যিনি পরে ‘সাহিত্যবিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত হয়ে বঙ্গবিখ্যাত হবেন, তিনি বাংলা সাহিত্যের ‘মিসিং লিংক’ খুঁজে পেলেন। সেটা পুঁথি সাহিত্য।
পুঁথি মুসলমান সমাজে বহুকাল ধরে প্রচলিত ছিলো। মুসলমানদের ঘরে ঘরে পুঁথি পাঠের আসর বসতো। ‘সন্ধ্যারাতে’ই খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকে যেত; তারপর পাটি বা চাটাই বিছিয়ে বা মাদুর পেতে গোল করে বসে পুঁথি পাঠ শুরু হয়ে যেতো। মাঝে মাঝে অনিয়মিত চা, হুকায় তাম্রকূটসেবন, আর চলতো পান। পানের রস আর পুঁথির রস মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। কফ, থুথু ফেলার জন্য চিলমচি থাকতো। পুঁথি পাঠ একটা দক্ষতার ব্যাপার ছিলো। সবাই পারতো না পুঁথি পড়তে। কারণ পুঁথির ভাষা। প্রায় চৌদ্দআনা পুঁথির রচয়িতা ছিলেন মুসলমান। তারা আরবি-ফার্সি শব্দের মিশেল ঘটিয়ে এমন অদ্ভুত এক ভাষায় পুঁথি রচনা করতেন যে, তার পাঠোদ্ধারের জন্য দক্ষতার প্রয়োজন হতো। তাছাড়া বাংলা ভাষা তখন শৈশব দশা কাটিয়ে উঠছিলো। শব্দ গঠন, শব্দের বানান বর্তমান রূপ পায়নি।
আমি আমার দাদা আবিদুর রহমান চৌধুরী, চাচা মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর পুঁথি পাঠ শুনেছি বহুদিন। কিছুদূর পড়া হয়ে যাবার পর তাঁরা আবার তার অর্থও বুঝিয়ে দিতেন। মোস্তাফিজ চাচার পিতা জবল আহমদ চৌধুরী আমাদের হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি পুঁথির ছন্দে ‘কওমে মুছা খাঁ’ নামে আমাদের বংশের একটি ইতিহাস লিখে গেছেন। সেই পুঁথি হস্তগত করার জন্য পিতা-পুত্র সাত্তার চৌধুরী ও ইসহাক চৌধুরী বহুদিন আমাদের গ্রামে ঘুরেছেন।
সমস্যা হলো অধিকাংশ পুঁথি ছিলো হস্তলিখিত। হাতের লেখা পড়া কঠিন কাজই ছিলো। এখানেই সাহিত্যবিশারদ, ড. আহমদ শরীফ, আবদুল হক চৌধুরী, আমার শিক্ষক অধ্যাপক সুলতান আহমদ ভূঁইয়া, ইসহাক চৌধুরী ও তাঁর পিতা আবদুস সাত্তার চৌধুরীর জিৎ।
পুঁথি রচয়িতার আবার লিপিকর থাকতেন। তাঁরাও কবি। পুঁথি মুখে মুখে রচনা করে যেতেন একজন, লিখে নিতেন অনেকজন। সমস্ত পুঁথি পদ্যে রচিত; পয়ার, ত্রিপদী ইত্যাদি নানারকম ছন্দ তার। পুঁথিতে একটা শব্দ পাওয়া যায়, ‘পুনি’, বেশ মজার-অর্থ পুকুর। প্রাচীন জায়গা জমির দলিলেও সম্ভবত পুনির প্রচলন ছিলো।
সাধারণ মানুষই ছিলেন পুঁথির সমঝদার। তারাই পুঁথির রস উপভোগ করতেন, যতœ করে পুঁথি রাখতেন। জমিদাররাও রাখতেন। আমাদের গ্রামে পন্ডিত আবুল হোসেন নামে একজন জমিদার ‘গজন্দর নামা’ নামে একটি পুঁথি রচনা করেছিলেন।
পুঁথি সংগ্রহে সাহিত্যবিশারদই অগ্রণী। তিনিই প্রথম পুঁথি সংগ্রাহক এবং পুঁথি সাহিত্যের প্রতি বাংলার বিদ্বৎ সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর দু’জন শিষ্যের কথা আমরা জানি-আবদুল হক চৌধুরী ও আবদুস সাত্তার চৌধুরী। এই দুজনের আগে, সাহিত্য বিশারদের পরে সাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরীর পিতা আশুতোষ চৌধুরী একজন সংগ্রাহক ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত সংগ্রাহক ছিলেন। আবদুল হক চৌধুরী খুবই জ্ঞান পিপাসু ও অনুসন্ধিৎসু মানুষ ছিলেন। শুধুমাত্র অধ্যবসায় ও শ্রম দিয়ে তিনি উত্তরকালে একজন কৃতি গবেষক, সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ হিসেবে পরিচিত হন।
সাহিত্যবিশারদ আবদুস সাত্তার চৌধুরীকে পুঁথি সংগ্রহের কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। আবদুস সাত্তার চৌধুরী গ্রামের মানুষ। পুঁথি সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিলো। তাঁর গ্রামে ও আশেপাশের গ্রামে সুর করে পুঁথি পাঠ করতে তিনি শুনেছেন। তিনি সেকালের ছাত্রবৃত্তি পড়া মানুষ; ভাষা এবং ব্যাকরণটা ভালো করে রপ্ত করেছেন। এবার পুঁথির পাঠোদ্ধারে সে জ্ঞান কাজে লাগলো। গ্রামে গ্রামে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুঁথি সংগ্রহ করে সাহিত্য বিশারদকে এনে দিতে লাগলেন। পরে সাহিত্য বিশারদ পুঁথি পরিচিতি নামে যে বিশাল গ্রন্থ লেখেন, তাতে সাত্তার চৌধুরীর সংগৃহীত বেশ কিছু স্থান পেয়েছে। আবদুস সাত্তার চৌধুরী তাঁর সংগৃহিত কিছু পুঁথি রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলা একাডেমীকে দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সৈয়দ আলী আহসান সাহেব সাত্তার চৌধুরীকে পুঁথি সংগ্রাহকের চাকরি দেন। ইসহাক চৌধুরীর ওপর আজাদীতে আমার লেখা বের হবার পর একজন ফোন করে আমাকে বলেন, পিতাপুত্র পুঁথি বিক্রি করেছেন, দান করেন নি। পুঁথি সংগ্রহ করে সাত্তার সাহেব জীবিকা নির্বাহ করতেন। পুঁথি সংগ্রহ তাঁর চাকরির অন্তর্ভুক্ত ছিলো। যিনি আমাকে এসব কথা বলেছেন, আমি তার উদ্দেশ্যে বলতে চাই, চাকরিও যদি হয়, সে চাকরি করতে তখন তো কাউকে পাওয়া যায় নি। আর পুঁথি সংগ্রহ কঠিন কাজ। পুঁথির জ্ঞান না থাকলে, পুঁথি পড়তে না জানলে কিভাবে পুঁথি সংগ্রহ করা যাবে। সাত্তার সাহেবের সে গুণ ছিলো, সে কারণে তিনি পুঁথি সংগ্রহ করে দিয়ে ধন্যবাদার্হ হয়েছেন, জাতির কৃতজ্ঞাভাজন হয়েছেন। আমি তো পুঁথি সংগ্রহ করতে পারতাম না। কারণ আমি পুঁথি পাঠ করতে জানি না। সব পুঁথিই যে তিনি বিক্রি করেছেন এমন নয়, কিছু পুঁথি দান তো অবশ্যই করেছেন।
সাত্তার সাহেবের কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি পুত্রকেও পুঁথি পাঠে পারদর্শী করে গড়ে তুলেছেন। পুত্র ইসহাক চৌধুরী তাঁর অসমাপ্ত কাজ শেষ করেছেন। ইসহাক শুধু পুঁথি নয়, পালাও উদ্ধার করেছেন। দলিল-দস্তাবেজ, খতিয়ানও পড়তে পারতেন।
ইসহাক চৌধুরী পুঁথি ঘেঁটে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অনেক জটিল গ্রন্থি উন্মোচনে মূল্যবান অবদান রেখেছেন। যেমন কবি রহিমুন্নিসা। প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ড. মুহম্মদ এনামুল হক সিদ্ধান্ত করেছিলেন, রহিমুন্নিসা মধ্যযুগের একমাত্র মুসলিম মহিলা কবি। ফলে রহিমুন্নিসা মধ্যযুগের প্রথম মুসলিম মহিলা কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেলেন। ইসহাক চৌধুরী এ বিষয়ে অনেক অনুসন্ধান চালিয়ে প্রমাণ করে দেন যে রহিমুন্নিসা উন্নিশ শতকে বর্তমান ছিলেন। তাঁর জীবনকাল যদি উনিশ শতক হয় তাহলে তিনি মধ্যযুগের কবি হতে পারেন না।
ইসহাক সাহেব জামিরুন্নেসা নামে বোয়ালখালী থানার কধুরখীল গ্রামের একজন কবির সন্ধান দেন, যিনি সত্যই মধ্যযুগেরই কবি ছিলেন।
আলাওলের জন্মস্থান চট্টগ্রাম না ফরিদুপুর এ নিয়ে একটা বিতর্ক রয়েছে। সৈয়দ আলী আহসান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে আমার চাচা কবি আলাদীন আলীনূরের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বিতর্ক হয়েছিলো। আলী আহসান সাহেব মনে করতেন আলাওলের জন্মস্থান ফরিদপুর, আলীনূর সাহেব মনে করতেন চট্টগ্রাম। ইসহাক চৌধুরী এ বিষয়ে বিস্তর বইপুস্তক ঘেঁটেও কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নি। যদিও হাটহাজারীতে আলাওলের নামে দীঘি ও মসজিদ রয়েছে।
মলকা বানুর জন্মস্থান নিয়ে যে বিতর্ক ছিলো ইসহাক চৌধুরী তা নিরসন করেন। মলকা বানুকে হাটহাজারীর সন্তান হিসেবে সবাই সিদ্ধান্ত করেছিলেন। কিন্তু ইসহাক চৌধুরী প্রমাণ করে দেখান মলকা বানু বাঁশখালীর বাসিন্দা। করিম সাহেবও এ মতের পরিপোষকতা করেন।
আস্কর আলী পÐিত রচিত পুঁথি ও গান উদ্ধার করে ইসহাক চৌধুরী তাঁকে লোক সমক্ষে হাজির করেন। আস্কর আলীর সমস্ত রচনা তিনি বাংলা একাডেমিতে জমা দেন। সাহিত্যিক আহমদ ছফা মৃত্যুর পূর্বে আস্কর আলী পন্ডিত সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। আমাকে তিনি বলেছিলেন, আস্কর আলী পন্ডিতের গানে তিনি মুগ্ধ। সে সব গানে তিনি সুরারোপ করে গাওয়াতে চেয়েছিলেন। শিল্পী আবদুল গফুর হালী আস্কর আলী পন্ডিতের বেশ কিছু গান গেয়েছেন।
গ্রামে যাঁরা নিভৃতে ইতিহাস চর্চা ও সাহিত্য সাধনা করেন, তাদের যোগসূত্র ছিলেন ইসহাক চৌধুরী। ফটিকছড়ির চৌধুরী আহমদ ছফা, হাটহাজারীর হাশেম মাস্টার, রাউজানের হারুনুর রশিদ মাস্টার ইসহাকের সুহৃদ ছিলেন।
পুঁথি, পালা ও প্রাচীন দলিল অনুসন্ধানের জন্য ইসহাক চৌধুরী চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করেছেন। তাঁর পরিশ্রমের ফসল, সংগৃহীত পুঁথি-পুস্তক বর্তমান ও ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য তিনি দান করে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণাগারে ও মিউজিয়ামে।
ইসহাক চৌধুরীর আত্মার শান্তি কামনা করি।