চট্টগ্রামের মাঠ প্রশাসনে ১৯ নারীর এগিয়ে চলা

27

রাহুল দাশ নয়ন

নিজ বাসায় অনেকসময় বাচ্চাকে কোলে নিয়েই অফিসিয়াল ফাইলে স্বাক্ষর করেন। সপ্তাহে সাতদিন ২৪ ঘণ্টা করে কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে কখনো বিরোধ মীমাংসা, কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালত চালাতে ছুটে যান মাঠেঘাটে। সভা, সেমিনারেও উপজেলার সংকট সমাধানে আলোচনায় মেতে থাকেন মুখ্যজন হয়ে। কর্মক্ষেত্রে নারী নয়, একজন মানুষ হিসেবে কাজ করেন। আর এ কাজটি করতে সবচেয়ে বেশি পরিবারের সহযোগিতা পান বলে জানিয়েছেন বাঁশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার। গত ছয়মাস বাঁশখালীতে দায়িত্ব পালন করা এ নারী অনেকটা সফল।
বাংলাদেশ তথ্য বাতায়নের সূত্রমতে, চট্টগ্রামের মাঠ প্রশাসনে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, স্থানীয় সরকার পরিচালক, ইউএনও, এসিল্যান্ড ও সহকারী কমিশনার হিসেবে ১৯ নারী দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে চারজন ও এসিল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পাঁচজন।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) পদে ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি, স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক পদে শাহিনা সুলতানা, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক পদে লুৎফুন নাহার দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও মাঠ পর্যায়ে মিরসরাইয়ে মাহফুজা জেরিন, বাঁশখালীতে জেসমিন আক্তার, চন্দনাইশে মাহমুদা বেগম ও কর্ণফুলী উপজেলায় মাসুমা জান্নাত নির্বাহী কর্মকর্তা পদে দায়িত্বে আছেন। এসিল্যান্ড হিসেবে রাঙ্গুনিয়ায় মারজান হোসাইন, চন্দনাইশে ডিপ্লোমেসি চাকমা, পটিয়ায় ফাহমিদা আফরোজ, লোহাগাড়ায় নাজমুন লায়েল, বোয়ালখালীতে নুসরাত ফাতেমা চৌধুরী কর্মরত আছেন। সিনিয়র সহকারী কমিশনার পদে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে কর্মরত আছেন গাজালা পারভীন রুহী, নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী, তাহমিনা আক্তার, জেলা প্রশাসনে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে সুনন্দা রায়, সিনিয়র সহকারী কমিশনার পান্না আক্তার ও চান্দগাঁও সার্কেল এসিল্যান্ড হিসেবে ফেরদৌস আরা কর্মরত আছেন। এরা প্রত্যেকেই কর্মক্ষেত্রসহ সামাজিক অবস্থানে সফল নারী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত।
সংসারের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের কাছে কাজ হচ্ছে জীবনের অংশ। আমি একজন নারী হলেও সংসার ও অফিসের কাজ সমানভাবেই গুরুত্ব দিই। ফাঁকিবাজি না করেও কিভাবে আন্তরিকভাবে কাজ করা যায় সেই চেষ্টা করি। আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে যেকোন বিষয়ে সফলতা পাওয়া যায়। নারীরা এমন আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছে বলেই কর্মক্ষেত্রে অবস্থান বাড়ছে এবং সফলতাও মিলছে। অনেক উপজেলার দায়িত্বে আছেন নারী। এসিল্যান্ড হিসেবেও অনেক নারী দায়িত্ব পালন করছেন।’
প্রতিটি উপজেলার ভালোমন্দ দেখভালের দায়িত্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। কর্মক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় উপজেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ এই কর্মকর্তাদের। যেখানেই সংকট সেখানেই দৌঁড়াতে হয়। এই পদে পুরুষের মতো পরিবার ও সংসার সামলে নারীরাও সফল। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, মিরসরাই, বাঁশখালী ও কর্ণফুলীর মতো উপজেলার প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন নারী।
নিজেদের কর্মপরিধি সম্পর্কে চন্দনাইশের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা বেগম পূর্বদেশকে বলেন, ‘মেয়েদের জীবনটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। সংসার, চাকুরি ও মায়ের দায়িত্ব সমানভাবে পালন করতে হয়। কিন্তু আমি বড় হবো, বিয়ে হয়ে যাবে এমন ধরনের বিষয় নিয়ে বড় হইনি। আমি বড় হয়ে ভালো একটি চাকুরি করবো সেটিই মাথায় ছিল। আমার পরিবার সেই বিষয়টিই আমার মাথায় ছোটকাল থেকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি কর্মক্ষেত্রে নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবেই কাজ করি। সরকার ও রাষ্ট্র নারীকে যেভাবে সম্মান দেয়, অনেক পরিবার সেটা দেয় না। পরিবার থেকেই নারীকে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যেটা আমি আমার পরিবার থেকে পেয়েছি। সংসার জীবনে আমার স্বামীও চান আমি তার চেয়ে বড় হই। প্রশাসন কিংবা সংসার সবখানেই আমি সহযোগিতা পাই।’
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার পূর্বদেশকে বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে নারী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে কাজ করি। সবসময় দায়িত্ব পালনের চিন্তা করি। যে দায়িত্ব সরকার আমাকে দিয়েছে সেটি জনগণের জন্য যেভাবেই হোক পালন করার চেষ্টা করি। সংসার ও চাকুরি অবশ্যই চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলতে হয়। কিন্তু আমি দায়িত্বটাকে কনসিডার করি না। সংসার ও চাকুরি সমানভাবে চালাতে পরিবারের একটা বড় সাপোর্ট থাকে। আমি আমার পরিবার থেকে সাপোর্টটা পাই। আমার বাচ্চা, শ্বাশুড়ি, স্বামী সবাই বুঝে আমি চাকুরি করছি আমাকে সাপোর্ট দেয়া দরকার। আমাদের ২৪ ঘণ্টা ও সাতদিন ডিউটি করা একটু কষ্টকর হলেও এটাই আমার দায়িত্ব। আমি অনেকসময় বাসায় বাচ্চাকে কোলে নিয়েও ফাইলে স্বাক্ষর করি। পেশাগত চ্যালেঞ্জ থাকলেও পরিবার ও প্রশাসনে আমি সমানভাবে কাজ করার চেষ্টা করি।’
ভূমি ব্যবস্থাপনার যাবতীয় দায়িত্ব এসিল্যান্ডের। নামজারিসহ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে বড় ভূমিকা রাখতে হয় এসিল্যান্ডকেই। সংকট মোকাবেলায় রাত-বিরাতে ছুটতে হয়। পাহাড় কর্তন প্রতিরোধ, ভূমি জরিপের মতো কাজেও থাকতে হয় মাঠে। নানা পরিস্থিতি মোকাবেলার এমন সাহস নিয়েই পাঁচ উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে দায়িত্ব পালন করছেন পাঁচ নারী।
রাঙ্গুনিয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারজান হোসাইন পূর্বদেশকে বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই। কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় আমি সবকাজই করছি। কিন্তু পুরুষের চেয়ে মেয়েটিকে একটু অন্যভাবে দেখা হয়। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকবেশি আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করছি। পরিবার ও অফিস একসাথে চালাতে গেলে তো কিছু টানাপোড়েন হয়। পরিবার থেকে সাপোর্ট না পেলে এতদূর পর্যন্ত আসা যেতো না। দেখা যায়, পরিবার ম্যানেজ করতে গিয়ে অফিসে সমস্যা হচ্ছে। আবার আমি অফিসে কাজ করছি কিন্তু পরিবারকে একটু সময় দিতে পারছি না এটা অসুবিধা। সবকিছু মিলিয়ে ব্যালেন্স করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। নারীদের সমানভাবে দেখতে আমাদের অনেক বেশি কাজ করতে হবে। একজন নারী বাচ্চাকে বাসায় রেখে অফিস করাটা অনেক কষ্টকর। নারীরা সবধরনের সুবিধা পেলে আরোও অনেকদূর এগিয়ে যাবে।’