চট্টগ্রামের কোথাও নেই ‘ফায়ার সেফটি প্ল্যান’!

39

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের জনবহুল বাণিজ্যিক স্থাপনা, বিপণী কিংবা মার্কেটগুলোর কোথাও নেই ‘ফায়ার সেফটি প্ল্যান’। ফায়ার সেফটি প্ল্যান না মানায় ঝুঁকিতে রয়েছে নগরীর পৌনে এক হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। আবার একই কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে হাজারের অধিক বাণিজ্যিক স্থাপনা ও মার্কেট। যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমানা-২০১৪ অনুযায়ী, ভবনে ন্যূনতম ৫০ জন বসবাসকারীর জন্য ১টি জরুরি নির্গমন সিঁড়ি থাকবে। ৫০০ জন পর্যন্ত ২টি, এক হাজার জন পর্যন্ত ৩টি এবং এক হাজারের ঊর্ধ্বে বসবাসকারীর জন্য ৪টি জরুরি নির্গমন সিঁড়ির বিষয়টি ফায়ার সেফটি প্ল্যানে নিশ্চিত ও চিহ্নিত করতে হবে।
কিন্তু বাস্তবে এ নিয়ম কোন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই মানা হয়নি। বরং যে যার যেমন ইচ্ছে মতো ভবন নির্মাণ করেছেন। ফলে মৃত্যুঝুঁকি হাতে নিয়ে প্রতিনিয়ত ঘর থেকে বের হয় চট্টগ্রামের মানুষ। বাণিজ্যিক স্থাপনা, মার্কেটসহ সবক্ষেত্রেই অভিন্ন চিত্র।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি চাক্তাইয়ের ভেড়া মার্কেট বস্তিতে অগ্নিকান্ডে ৮ জন, রাজধানী ঢাকার চকবাজার চুড়াহাট্টায় ৭০ জন এবং সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ঢাকার বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডে ২৫ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনায় দেশের ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলোর বিষয়টি আবারো সামনে আসে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে কোথাও মিলেনি ফায়ার সেফটি প্ল্যান। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলোর পরিসর বেশি থাকায় ঝুঁকি কিছুটা কম। নগরের আনাচে কানাচে গড়ে উঠা কিন্ডারগার্টেনগুলোর বেশিরভাগের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। জড়োসড়ো ঘিঞ্জি ভবনের ছোট ছোট কক্ষে চলে পাঠদান। অনেকক্ষেত্রে সিঁড়িগুলোও একেবারে সরু। তাছাড়া নগরীর বাণিজ্যিক স্থাপনা ও মার্কেটগুলোর কোন ক্ষেত্রে মানা হয়নি ফায়ার সেফটি প্ল্যান।
বিশেষত চট্টগ্রামে পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। যে কারণে যেকোন অগ্নি দূর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির আশংকা বেশি থাকে। আবার শহুরে গিঞ্জি সড়কগুলো দিয়ে অলি গলির রাস্তা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো প্রবেশ কষ্টকর হয়। ফলে ভবনগুলোতে ফায়ার সেফটি প্ল্যান কার্যকর না হলে যে কোন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির আশংকা রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ফায়ার সার্ভিস ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ স্পট নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে সমগ্র চট্টগ্রামে অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ, অতিঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণিতে ভাগ করে। জরিপ মতে, ফায়ার সার্ভিস আগ্রাবাদ প্রধান কার্যালয়ের আওতায় ঝাউতলা বস্তি, আমবাগান বস্তি, সেগুনবাগান বস্তি, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, সিঙ্গাংপুর সমবায় সমিতি মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, কালুরঘাট ফায়ার সার্ভিস এলাকায় বহদ্দারহাট হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বকতেয়ার মার্কেট, নজু মিয়াহাট মার্কেট, বলিরহাট মার্কেট, চাক্তাই ফায়ার স্টেশনের আওতায় ভেড়া মার্কেট, চালপট্টি, শুটকি পট্টি, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, মিয়া খান নগর পুরাতন ঝুট মার্কেট, ওমর আলী মার্কেট, বন্দর এলাকার মধ্যে পোর্ট মার্কেট, বড়পুল বাজার, ইশান মিস্ত্রি বাজার মার্কেট, ফকির হাট মার্কেট, নয়া বাজার মার্কেট, ফইল্যাতলী বাজার, ইপিজেড ফায়ার স্টেশনের আওতায় চৌধুরী মার্কেট, রেলওয়ে বস্তি, কলসী দিঘীর পাড় এলাকার কলোনি, আকমল আলী রোড এলাকাধীন কলোনি, চন্দনপুরা ফায়ার সার্ভিসের চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিং মল, গুলজার মার্কেট, নন্দকানন ফায়ার সার্ভিসের আওতায় রিয়াজ উদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, টেরি বাজার, তামাকুমÐি লেন, বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের আওতায় ২নং গেট রেলওয়ে বস্তি, ড্রাইভার কলোনি, অক্সিজেন রাস্তা সংলগ্ন বস্তি, বার্মা কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি, শেরশাহ কলোনিকে ‘অতিঝুঁকিপূণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার এসব স্পটগুলোর বেশ কয়েকটির আওতায় রয়েছে অসংখ্য মার্কেট ও বিপণী।
তথ্য মতে, শুধুমাত্র রিয়াজ উদ্দিন বাজারেই ছোটবড় ১২৮টি মার্কেটে ১০ হাজারের অধিক দোকান রয়েছে। আবার আরেক জনবহুল ব্যবসাকেন্দ্র তামাকুমন্ডি লেইনের অধিনে ১১০টি মার্কেটে প্রায় ১০ হাজার দোকান রয়েছে। প্রসিদ্ধ ব্যবসায়িক এলাকা টেরিবাজারে ছোটবড় প্রায় ৮৫টি মার্কেটে রয়েছে প্রায় দুই হাজার দোকান। জহুর হকার্স মার্কেটেই রয়েছে প্রায় ৮ শতাধিক দোকান। তাছাড়া পুরো নগরীতে রয়েছে কয়েক হাজার বাণিজ্যিক স্থাপনা। যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা হয়।
তাছাড়া নগরীতে সরকারি ২১৭টি প্রাইমারি স্কুল, ১১টি সরকারি হাইস্কুল, ৭টি কলেজ রয়েছে। আবার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০৭টি এমপিওভুক্ত হাইস্কুল, ২৫টি মাদ্রাসা, ১৭টি কলেজ এবং ১১৮টি স্কুল এন্ড কলেজ, নন এমপিওভুক্ত একটি হাইস্কুল, ১৯টি মাদ্রাসা, ১৬টি কলেজ এবং ১২টি স্কুল এন্ড কলেজ রয়েছে। এসবের বাইরে নগরীতে ৩২টি কওমী মাদ্রাসা এবং দেড় শতাধিক কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। সবমিলিয়ে নগরীতে ৭৭২টির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে ফায়ার সেফটি প্ল্যান মানা হয়নি।
তথ্য অনুযায়ী, নগরীর প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৪৬০ জন, হাইস্কুলগুলোতে ১ লাখ ৪২ হাজার ৬৮১ জন, কলেজগুলোতে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৩ জন, মাদ্রাসায় ১৭ হাজার ৪৩ জন এবং কওমী মাদ্রাসায় ৮ হাজার ৬৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাছাড়া কিন্ডারগার্টেনগুলোতে গড়ে ২শ হিসেবে ৩০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবনে ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন না হওয়ায় অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর উপ-সহকারী পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দী পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা নগরীর প্রায় প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছি। “কাজীর গরু খেতাবে আছে, গোয়ালে নেই” অবস্থা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবনগুলোতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনে কোথাও ফায়ার সেফটি প্ল্যান কার্যকর পাইনি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে বেসরকারি বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেনগুলোতে ঝুঁকির মাত্রা বেশি। আবার বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলোতেও ফায়ার সেফটি প্ল্যান মানা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নোটিশ দিয়েছি। যাতে যেকোন দুর্ঘটনায় যাতে ঝুঁকি এড়ানো যায় এবং অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকি থাকে। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের সাথে মতবিনিময় করেছি। তাদের সচেতনতার আওতায় আনার চেষ্টা করছি।’
কথা হলে চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা (উপ-সচিব) সুমন বড়ুয়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান ভবনগুলো আগে নির্মিত। রাতারাতি পুরোনো ভবনগুলোতে ফায়ার সেফটি প্ল্যান যথাযথ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তবে এখন স্কুলগুলোতে নতুন নতুন ভবন হচ্ছে। নির্মিতব্য ভবনগুলোতে যাতে ফায়ার সেফটি প্ল্যানের বিষয়টি থাকে সে বিষয়ে আমরা নজর দেব।’
তিনি বলেন, ‘অগ্নি নির্বাপণ সম্পর্কে আমাদের একটি স্কিমও রয়েছে। শিক্ষার্থীদের সচেতন করার জন্য আমরা কর্মশালা করার পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
চট্টগ্রাম মহানগরী কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের মহাসচিব রেজাউল করিম চৌধুরী পূর্বদেশকে জানান, ‘নগরীতে তাদের দেড়শ মতো কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। যেখানে গড়ে ২শ করে শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেই অগ্নি নির্বাপন বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হয়।’ তবে কিন্ডারগার্টেনগুলোর ভবনগুলোতে ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা সে বিষয়ে তিনি কোন তথ্য দিতে পারেননি।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি সালেহ আহমদ সুলেমান বলেন, ‘এক মাসের ব্যবধানে ঢাকায় দুটি বাণিজ্যিক স্থাপনায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আবার চট্টগ্রামেও অনেক বড় বড় মার্কেট ও বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। এগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল।’
এ ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, ‘শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ হলেও স্থাপনাগুলোতে অগ্নিঝুঁকি রয়ে যাচ্ছে। যেকোন স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো যদি যথাযথ তদারকি করেন তাহলে এ ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসবে।’