চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের স্মারক জব্বারের বলীখেলা

129

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলার ১১০ তম আসর গত ২৫ এপ্রিল শেষ হয়। লালদিঘী মাঠে বলীখেলা আয়োজন। বলী খেলা ছাড়াও প্রতিবছরের মতো এবারো বসছে ৩ দিন ব্যাপী বৈশাখী মেলা বসেছিল। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলী খেলায় প্রতিবছর সারা দেশ থেকে নামকরা বলীরা অংশ নেয়। নগদ টাকা ছাড়াও বিভিন্ন পুরস্কার প্রদান করা হয় বিজয়ীদের মাঝে। আর এ বলীখেলা দেখতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে লাখো মানুষে ভীড় জমে লালদিঘি ময়দানে। প্রসঙ্গত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ১৯০৯ সালে লালদীঘির মাঠে এ বলীখেলার আয়োজন করেছিলেন বদরপাতির আবদুল জব্বার সওদাগর। পরবর্তী সময়ে এটি জব্বারের বলী খেলা নামেই পরিচিত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, লালদিঘী ময়দানের আশে পাশে হাজারো ছোট বড় ভ্রাম্যমান দোকান বসিয়েছে বিক্রেতারা। গৃহস্থলির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রসামগ্রীই বেশি আনা হয়েছে ভ্রাম্যমান এসব দোকানে। ফার“ক নামের এক দোকানদার জানান, দা-বঁটি, শীতলপাটি, ফুলঝাড়–, হাতপাখাসহ ব্যবহৃত জিনিসপত্র বিক্রির জন্য এনেছেন তারা। মেলা ৩ দিনে হলেও মেলাটি ৫-৬দিন পর্যন্ত চলে। মেলা আনা পণ্যগুলোর মূল্যও কিছুটা ছাড় দিয়ে বিক্রি করে তারা। এ মেলায় প্রতিবছর পণ্য বিক্রির জন্য আসেন তারা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের পতনের পর এই দেশে বৃটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবস¤প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োাজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।
আরো জানা যায়, কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচন্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলিখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এখন পেশাদার বলির (কুস্তিগীর) অভাবে বলিখেলার তেমন আকর্ষণ না থাকলেও জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। তাই অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চিনে। জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘির ময়দানের চারপাশের এলাকা ঘিরে।
জব্বারের বলী খেলার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে যেমন কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলী খেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলী খেলা, পটিয়ায় আমজু মিয়ার বলী খেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলী খেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলী খেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলী খেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলী খেলা এখনও কোনরকমে বিদ্যমান।
এদিকে লালদিঘী ময়দানের একপাশে তৈরি করা হয় বলী খেলার ৪শ বর্গফুটের একটি মঞ্চ। ২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থের মঞ্চটি মাঠ থেকে ৫ ফুট উচ্চতা থাকে। মঞ্চের উপরে থাকে ৮ ইঞ্চি মাঠি। সাধারণ মানুষ যাতে মঞ্চে ভিড়তে না পারে সেজন্য দেয়া হচ্ছে প্রতিরোধক ভাউন্ডারি।
এবারের বলী খেলার স্লোগান ছিল ‘মাদকমুক্ত যুবসমাজ’। প্রতিবছরের ন্যয় এবারো তালিকাভুক্ত এক’শ বলী থেকে যাছাই বাচাই করে ৫০ জনকে খেলানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে সেমি ফাইনাল ও ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। সর্বমোট ৫০জন বলীকে পুরস্কৃত করা হয়।