চট্টগ্রামের অমর একুশের বইমেলা ২০২৩ সর্বজনীন সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন বইমেলার আশা করে নগরবাসী

195

জামাল উদ্দিন

এ কথা আজ অনেকেই জানেন যে অতীতের ধারাকে পেছনে ফেলে ২০১৯ সাল থেকে বিশাল এলাকা নিয়ে ভাষার মাস ফেব্রয়ারিতে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় বইমেলাÑ যা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর বইমেলায় রূপ নিয়েছে। এর আগে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিভিন্নজনের উদ্যোগে খÐ খÐ ভাবে বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো, যা পাঠকদের মিলনমেলায় পরিণত হতে বাধা হয়ে দাঁড়াতো। পরবর্তীতে আমরা কয়েকজন অনুভব করি যে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন। চট্টগ্রামে খÐ খÐ বইমেলার পরিবর্তে বৃহত্তর পরিসরে একটি মেলা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন ভাষার মাস ফেব্রæয়ারিতে। এইসব বিবেচনায় নিয়ে ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নব নির্বাচিত মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীনের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে তাঁর সহযোগিতা কামনা করি। তিনি বিষয়টি অনুধাবন করে ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ ও সিটি কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিচ্ছিন্নভাবে একাধিক স্থানে বইমেলার আয়োজন না করে পরবর্তী বছর থেকে বৃহৎ পরিসরে চট্টগ্রামে কেবল একটি মাত্র বইমেলা আয়োজন করার ঘোষণা দেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সকলকে নিয়ে তিনি এক বৈঠকের আয়োজন করেন। ঐ বৈঠকেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে ২০১৯ সালে অমর একুশের বইমেলা ১০ ফেব্রæয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম চত্বরে বৃহৎ পরিসরে একক বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন নিজেই এর দায়িত্ব নিলেন। চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সদস্য ছাড়াও চট্টগ্রামের কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও বিভিন্ন পেশাজীবী নেতাদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠিত হলো। উক্ত সভায় একটি কার্যকরী কমিটি এবং বিভিন্ন উপ-কমিটিও গঠিত হলো। ইতিপূর্বে বিচ্ছিন্নভাবে যারা বইমেলা নামে বিভিন্নস্থানে মেলা আয়োজন করতো তাদের কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন নি। সকলেই মেয়র-এর নেতৃত্বে একক বইমেলায় অন্তর্ভুক্ত হলেন।
২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত বইমেলায় প্রত্যাশার চাইতেও বেশি সংখ্যক প্রকাশক অংশগ্রহণ করলেন ঢাকা থেকে। মেয়র মহোদয়ের অভিপ্রায় ছিল ন্যূনতম ২৫জন প্রকাশক আনতে হবে ঢাকা থেকে। আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় সেই বছর ২০১৯ সালে শুধু ঢাকা থেকেই ৫০জন প্রকাশক অংশগ্রহণ করেন। তারই আলোকে ২০১৯ সালে ২০ দিনব্যাপী একটি সফল বইমেলা অনুষ্ঠিত হল। সুন্দর আয়োজন ও বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ার বদৌলতে এই মেলা মর্যাদা লাভ করল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর বইমেলায়।
২০১৯ সালে মোট ১১০ টি স্টল নিয়ে বইমেলা অনুষ্ঠিত হলে ঐ বছরের উদ্বোধনী ঘোষণা অনুয়ায়ী মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন ২০২০ সালের মেলার পরিধি দ্বিগুণ বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেন। আগের মতো আমাকে আবারো প্রকাশকদের মেলায় অংশগ্রহণের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। এবার মেলায় ১৫৮জন প্রকাশক অংশগ্রহণ করেছে। তৎমধ্যে ঢাকার প্রকাশক ১১৮জন এবং চট্টগ্রামের ৪০জন। বইয়ের স্টলের সাথে আছে লিটলম্যাগ কর্নার। বিবিধ সহ মেলায় মোট স্টল সংখ্যা ২৩০টি। অর্থাৎ ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালের মেলার পরিধি দ্বিগুণ পরিসরে। এই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত অমর একুশের বইমেলা, চট্টগ্রাম, ২০২০’। মেলাকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি নীতিমালাও তৈরী করা হয়েছে। আয়োজিত এই মেলার পরিধি হলো ১,২০,৩০০ বর্গফুট। বইয়ের স্টল ছাড়াও মেলাকে কেন্দ্র করে নানা সাংস্কৃতিক ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীরা অংশগ্রহণ করে পুরো বইমেলাকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলেন ।
মানুষের মনকে বিকশিত করতে, জ্ঞানের পরিধি বিস্তারে, সভ্যতার বিকাশে বইয়ের অবদান প্রসঙ্গে বলে শেষ করা যাবে না। সুতরাং বইমেলার গুরুত্ব¡ও অপরিসীম। ২০২০ সালের চলমান বইমেলা এই নিরীখে অত্যন্ত সফল। প্রতিদিন হাজার হাজার বইপ্রেমী মানুষ সপরিবারে এসেছেন বইমেলায়। এখানে একটি কথা না বললে নয় যে, জিমনেশিয়ামের বিশাল এই ময়দান ব্যবহারে এক টাকাও ভাড়া গুণতে হয় নি। মেয়র মহোদয়ের আন্তরিকতায় তা সম্ভব হয়েছে।
এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম চত্বরে ২০১৯ থেকে ২০২০ সাল দু’বছর ধরে অনুষ্ঠিত বৃহত্তর পরিসরের একক এই বইমেলার আয়োজনের মূল কৃতিত্ব অবশ্যই উদ্যোক্তাদের। তাঁদের সহৃদয় পদক্ষেপে এটি এখন একটি স্থায়ী এবং টেকসই রূপ নিয়েছে। এছাড়া তৎকালীন মেয়র ঘোষণা করেছিলেন বইমেলা প্রতি বছর ১০ ফেব্রæয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত একই নিয়মে অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পেরেশনের নতুন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতার কারণে ২০২১ সালের মেলা থেকে বঞ্চিত হলো চট্টগ্রামবাসী। ২০২২ সালে মেলা অনুষ্ঠিত হলেও ভ্যারাইটিশো মার্কা তথাকথিত বারোয়ারি মেলায় পরিণত হয়ে যায় এই বইমেলা।এটা কমিটির চরম ক্যর্থতা। যে কারণে বইমেলা পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। এই মেলায় পূর্বের ধারাবাহিকতায় ‘নীতিমালা ও নিয়মাবলী’ প্রাধান্য না দিয়ে যেনতেনভাবে মেলা করতে গিয়ে পুরো মেলাটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এমনকি স্বাধীনতা বিরোধী ও মৌলবাদী প্রকাশকেরও বইয়ে ভরে গিয়েছিল এই মেলা। ফলে নানা মহল থেকে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিলো।
এসে গেলো ২০২৩ সাল। ফেব্রæয়ারির প্রথম থেকে বাংলা একাডেমি বইমেলা অনুষ্ঠানের সকল প্রস্তুতি চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের বইমেলাও অনুষ্ঠিত হবার কথা ১০ ফেব্রায়ারি থেকে। কিন্তু জানুয়ারি মাসের প্রায় এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও, বইমেলা নিয়ে সিটি কর্পোরেশন পক্ষ হতে কোনো ধরনের সভ-সমাবেশ এখনো পর্যন্ত হয়নি। তাতে বইপ্রেমী নগরবাসীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এমনও শোনা যাচ্ছে, ২০১৯ ও ২০ সালের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বইমেলা আয়োজন আদৌ হবে কি না! এই নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কে নেবে এই দায়িত্ব? ২০২২ সালের মতো ভ্যারাইটিশো মার্কা তথাকথিত বারোয়ারি মেলা এবারও হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। এমনও শোনা যাচ্ছে, মেধা শ্রম দিয়ে যারা এই মেলা আয়োজন করেছিলেন, তাদেরকে নানা কৌশলে সরিয়ে দিয়ে মৌলবাদী জামায়াতিরাই সবকিছু হাতের মুঠোয় নিয়ে যেতে পারে।
এই মেলার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তমান মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর ওপর। মেয়র ছাড়াও তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। শুধু তাই নয় তিনি একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষকও। নগরবাসী আশাবাদী তাঁর হাত দিয়ে এই মেলা আরো সুচারুরূপে প্রসার লাভ করবে। তা না হলে তার ওপর সঞ্চিত তাবৎ আশা-ভরসা ও আস্থার ক্ষেত্র ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে। এছাড়া চট্টগ্রামের ক্রমবর্ধমান প্রকাশনা শিল্প হুমকির সম্মুখীন হবে। কেননা প্রকাশনা শিল্প যেহেতু আলু পটলের ব্যবসা নয়, তাই প্রকাশকরা তাদের সারা বছরের বিনিয়োগ হারিয়ে পথে বসবে। ক্রমবিকাশমান পাঠক সৃষ্টির নব অর্জিত প্রক্রিয়া মুখথুবড়ে পড়বে। এবং আমাদের মেয়র মহোদয়ের ভাবমূর্তি চরমভাবে কালিমালিপ্ত হবে। যা আমজনতা ও সুশীলসমাজ কারোরই কাম্য নয়। তবে আশার কথা, ২০২৩ সালের চট্টগ্রামে অমর একুশে বইমেলা নিয়ে বর্তমান মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. রেজাউল করিম চৌধুরীর সাথে মুঠেফোনে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমার সুপারিশ ও প্রস্তাবনা আমলে এনেছেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন যে, কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ও স্বাধীনতা বিরোধী কোনো বই মেলায় ঢুকতে দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণীত হবে।
এছাড়া তাঁর প্রতি আকুল আহŸান হলো এই মেলা জামায়াত শিবির চক্র কুক্ষিগত করার যে কৌশলী ভ‚মিকায় নেমেছে তিনি দৃঢ়ভাবে তা প্রতিহত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শনিষ্ঠ পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক কার্যকরি ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবেন। একই সাথে পুরোমেলার আয়োজন যেহেতু চসিক সমাজকল্যাণ স্ট্যান্ডিং কমিটির আওতায় সেহেতু বর্তমান কমিটির পরিবর্তন করাটাও অপরিহার্য। মেয়র মহোদয় এই বিষয়টিকে আমলে এনে গুরুত্ব দিলে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন একটি মেলা হবে এবং নগরবাসী ও প্রকাশকরা উপকৃত হবে।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
সাংবাদিক, লেখক ও প্রকাশক