চট্টগ্রামের অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক চিরায়ত ঐতিহ্য

82

গত ১২ বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলার ১১০তম আসর বসেছিল চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘি মাঠে। শতবছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে এবারও বলিখেলাকে কেন্দ্র করে নগরীর লালদিঘি থেকে শুরু করে আশেপাশের দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছিল এ বৈশাখী মেলা। কেলবমাত্র একদিন বলিখেলার জন্য নির্ধারিত হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে মেলা চলে কিন্তু তিনদিন। বাস্তবে দেখা যায়, কাগজে তিনদিন থাকলেও মেলার আমেজ চলে সপ্তাহব্যাপী। এ নিবন্ধটি যখন লেখা হচ্ছে তখন মেলা পঞ্চম দিনে গড়াল। কিন্তু মূল সড়কে মেলা না থাকলেও ফুটপাতে গ্রামীন লোকজ সামগ্রীর বিকিকিনি চলছে। যাইহোক, এমেলা বা বলী খেলাকে ঘিরে চট্টগ্রাম নগরসহ আশপাশের জেলা-উপজেলার সাধারণ মানুষের মাঝে শুরু হয় খুশি আর আনন্দের বন্যা। এ অঞ্চলের সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ দীর্ঘ প্রহর অপেক্ষায় থাকে কখন বলীখেলা শুরু হবে আর মেলা বসবে। মনের মত করে তাদের পছন্দের পণ্য কেনাকাটা করবে। কেননা একটি পরিবারের অপরিহার্য প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো যেখানে সচরাচর দোকান বা বাজারে পাওয়া যায়না সেগুলি জব্বারের বলীখেলায় ও মেলায় পাওয়া যায়।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বাঙালি সংস্কৃতির সকল উৎসবের মধ্যে চট্টগ্রামে লালদিঘির জব্বারের বলীখেলা ও মেলা অন্যতম। চট্টগ্রামকে শেলার মহর বললে অত্যুক্তি হবে না। সম্প্রতি পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরজুড়ে যেন মেলা বসেছিল। অনেক উপজেলা ও ইউনিয় সদরেও মেলার আয়োজন লক্ষ্য করা যায়। এর বাইরে ব্যবসায়ীদের চারটি সংগঠনের পৃথক পৃথক বাণিজ্য মেলা, বিজয় মেলা, বইমেলা, রাজশাহী সিল্ক ও জামদানী শাড়ির মেলাসহ সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন মেলা যেন বারোমাসি পাবনে পরিণত হয়েছে। এতোসব মেলার মধ্যে জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষ্যে আয়োজিত বৈশাখীমেলা মোটেই তার গৌরব-সৌর হারায়নি;বরং এর পরিধি দিনের পর দিন বাড়তেই আছে। বিশেষ করে এ মেলায় সকল স¤প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহণের ফলে সর্বশেষ এটি চট্টগ্রামবাসীর মিলনমেলায় পরিণত হয়। যেখানে ধর্ম, বর্ণ,জাত-পাত কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তৈরি হয় সম্পর্কের সেতুবন্ধন। বিশেষকরে, মেলাকে ঘিরে চট্টগ্রাম শহরের গৃহিণীদের মাঝে বেড়ে যায় কর্মব্যস্ততা। সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা যায় প্রাণচাঞ্চল্য। বলেছিলাম গত ২৪ এপ্রিল থেকে মূলমেলা শুরু হলেও এখনও চলছে মেলার আমেজ। এসময় লালদিঘি মাঠকে ঘিরে বক্সির বিট, আন্দরকিল্লা,সিনেমা প্লেস,হকার মার্কেট,পুরান গির্জা,কোতোয়ালী মোড়সহ আশপাশের কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে ভাসমান দোকান ও স্টল। সড়কের পাশে পসরা সাঝিয়ে রাখা হয়েছে মেলায় বিক্রির জন্য আনা ফুলঝাড়ু, হাতপাখা, খেলনা, গাছের চারা, দা-বঁটি, গহনা, মাটির ব্যাংক, শোপিস, হাতি-ঘোড়া থেকে শুরু করে শীতলপাটি মাটির তৈজষপত্র, হাতের তৈরি মুড়ি-মুড়কি, গজা, মনচ্ছড়ি, বাতাসা, কদমা, বেত বাঁশের জৈতষপত্র,ছোট ছোট হাতের তৈরি খেলনায় সাজছে মেলা প্রাঙ্গণ। এমনকি পড়া টেবিল থেকে শুরু করে ফুলশয্যার খাটও। মানুষের পদচারণায় মুখরিত ও জমে উঠেছে মেলার চিরাচরিত এতিহ্য। জব্বারের বলীখেলায় দেশের আনাচে কানাচে থেকে জমায়েত হয়। দেশের নামকরা বলীরা। আজ বিকেল ৪টায় লালদিঘির মূল মাঠে আগত বলিরা তাদের শক্তি প্রদর্শন করে থাকে। বলাবাহুল্য যে, ১৯০৯ সালে ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদিঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মরহুম আলহাজ্ব আবদুল জব্বার সওদাগর। সেই থেকে এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ খেলার আদলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্ন নামে বলীখেলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের পতনের পর এই দেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসন শুরু হয়। তাদের শোষন ও পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মরহুম আবদুল জব্বার এ বলীখেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ব্যতিক্রমধর্মী এ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার সওদাগরকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু দেশপ্রেমিক আবদুল জব্বার তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামলে আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামি-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন বলে জানা যায়। এখন বার্মার আরাকান থেকে বলী না আসলেও শক্তিশালী বলীর অধিকাংশই টেকনাফ-কক্সবাজর থেকেই আসেন। ান্যান্যবারের মত এবারও প্রায় শতাধিক বলী দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এস অংশগ্রহণ করেন।
বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হিসেবে এখনো বাঙালির মনে বিশেষ স্থান নিয়ে আছে এই জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা। এখানে আসলে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণের স্পন্দন খুজে পাওয়া যায়। গ্রামবাংলার খেলনা, মাটির ঘ্রাণ, বাঙালির সংস্কৃতির নানা উপাদান মিলেমিশে একাকার এই মেলায়। এ মেলা বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের এক বিশাল স্মারক। যার বিকল্প দেশে আর নেই। আমাদের সকলের উচিৎ এটিকে আরো সমৃদ্ধ ও আরো বর্ণিল করার প্রয়াস অব্যাহত রাখা।