ঘড়ি বানানোর অভিজ্ঞতায় সেতু সংস্কার, উঠছে প্রশ্ন

2

পূর্বদেশ ডেস্ক

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটে সেতু বিপর্যয়ে গতকাল সোমবার মৃতের সংখ্যা দেড়শর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। স্থানীয় একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন মৃতদের বেশিরভাগ নারী ও শিশু। গতকাল পর্যন্ত ১৪১টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে ৪৭ জন শিশু রয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ রাজ্যের মোরবী শহরের মাচ্ছু নদীতে সেতুটি ধসে শত শত মানুষ নদীতে ডুবে গেছেন। ঘটনার সময় প্রায় চারশো মানুষ সেতুটির উপরে ছিলেন বলে জানা যাচ্ছে। রাজ্যের মন্ত্রী ব্রিজেশ মের্জা জানিয়েছেন এখনো পর্যন্ত ১৭৭ জনেরও বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে।
সেতুটি মেরামতের পর আবার চালু হওয়ার মাত্র কয়েকদিন পরই এই ঘটনা ঘটলো। খুলে দেয়ার আগে সঠিকভাবে সেটি পরীক্ষা করা হয়েছিল কি না সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঘটনা তদন্তে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ।
ঔপনিবেশিক যুগের ব্রিজটি ১৯ শতকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময় নির্মিত হয়েছিল। দুইশ ত্রিশ মিটারের অবকাঠামোটি স্থানীয়ভাবে জুল্টো পুল নামে পরিচিত। এটি ওই এলাকার একটি জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ।
সোমবার সন্ধ্যা নামায় উদ্ধারকাজ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। আজ সকালে আবার উদ্ধারকাজ শুরু করা হবে। নদীর জলের তলায় কাদার মধ্যে এখনও বহু মানুষের দেহ আটকে রয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রবিবার সন্ধ্যায় ব্রিটিশ আমলের তৈরি ওই সেতুতে প্রায় ৫০০ মানুষ ভিড় করেছিলেন। সে সময়ই আচমকা ভেঙে পড়ে ঝুলন্ত সেতুটি। এক প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছেন, সেতুতে প্রচুর মানুষের জমায়েত ছিল। সেতু ভেঙে পড়ার পরই বহু মানুষ মাচ্ছু নদীতে পড়ে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই সাঁতরে ডাঙায় ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অনেকেই সাঁতার কাটতে জানতেন না, তাদের অনেককে টেনে ডাঙায় তুলেছেন উদ্ধারকারীরা। শতাব্দীর প্রাচীন ওই সেতুটি সংস্কারের জন্য বন্ধ ছিল। গত ২৬ অক্টোবর আবার তা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তার মধ্যেই এই বিপর্যয় ঘটল। এই ঘটনায় সেতু সংস্কার সংস্থার কর্মী-সহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

১২৫ জনের বেশি ওঠা মানা
দীর্ঘ দিন ধরে সংস্কারের পর চার দিন আগে গুজরাতি নববর্ষের দিন খুলে দেওয়া হয়েছিল গুজরাটের মোরবী শহরের ঝুলন্ত সেতুটি। তার পরেই ঘটে গেল এত বড় বিপর্যয়! দরবারগড় রাজবাড়ি ও নজরবাগ রাজবাড়িকে জুড়তেই আমদাবাদ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে মাচ্ছু নদীর উপর সেতুটি তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। প্রায় ১৪০ বছর আগে।
মোরবীর দেশীয় রাজারা সেতুটি বানিয়েছিলেন। উনিশ শতকে মোরবির শাসক ওয়াঘজি রাজাজি ঠাকোর সেতুটি নির্মাণ করেন। শোনা যায়, সেতু তৈরি করতে ইংল্যান্ড থেকে জিনিসপত্র আনিয়েছিলেন ওয়াঘজি। ১৮৭৯ সালের ২০ ফেব্রæয়ারি সেতু উদ্বোধন করেন তৎকালীন বম্বে প্রেসিডেন্সির গভর্নর রিচার্ড টেম্পল। সেই সময় সেতুটি তৈরি করতে খরচ পড়েছিল প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। স্বাধীনতার পর এই সেতু গুজরাটের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসাবে নজর কাড়ে।
এই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে জয়সুখজি উদ্ধবজি পটেলের মালিকানাধীন ওরেভা গ্রুপ। সেতু সারাইয়ের কাজ নিয়ে ওই গোষ্ঠীর অন্তর্গত সংস্থা অজন্তা ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে মোরবী পুরসভার চুক্তি হয়। সংস্কারের জন্য গত মার্চ মাস থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় সেতুটি। সিদ্ধান্ত হয়, অন্তত আট থেকে ১২ মাস সেতুটি বন্ধ রাখা হবে। তার পরেও কেন সাত মাসের মাথায় জনসাধারণের জন্য সেটি খুলে দেওয়া হল, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
প্রশ্ন উঠছে, সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে না হয়নি, তা ভাল করে খতিয়ে না দেখে পুরসভার ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট’ ছাড়াই কেন সেতুটি গত ২৬ অক্টোবর খুলে দেওয়া হল? গুজরাটে সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। বিরোধীদের প্রশ্ন, ভোটের দিকে নজর রেখেই কি তাড়াহুড়ো করে সেতুটি খুলে দেওয়া হয়েছে? সংস্কারে গলদ ছিল কি না, সেই প্রশ্নও উঠে স্বাভাবিক ভাবেই।
ওরেভার অজন্তা সংস্থাই ১৫ বছরের জন্য সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছে। ২০২০ সাল থেকে লাগাতার আলোচনার পর চলতি বছরের মার্চেই সেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পুরসভা সূত্রেই খবর, মেরেকেটে ১২৫ জনের ভার বহনের ক্ষমতা ছিল গুজরাটের মোরবীর ঝুলন্ত সেতুটির। তা সত্তে¡ও কেন ৪৫০-৫০০ জন মানুষ ওই পায়ে হাঁটার সেতুতে উঠে পড়েছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। স্থানীয়দের দাবি, টিকিট বিক্রি করা হলেও, ভিড় নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থাই করেনি স্থানীয় প্রশাসন কিংবা সংস্কারের দায়িত্বে থাকা ওই বেসরকারি সংস্থাটি।
ভোটের আগে এই ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই মুখ পুড়েছে গুজরাট সরকারের। রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী ব্রিজেশ মেরজা তাই কোনও বিতর্কে না গিয়ে বলেছেন, সরকার এই দুর্ঘটনার দায় নিচ্ছে।
তদন্ত কমিটি করার কথাও বলেছে গুজরাট সরকার। পুরসভার তত্ত্বাবধানে থাকা এই সেতুর মেরামতি সরকারি দরপত্রের মাধ্যমেই করানো হয়েছে। পাঁচ দিনের মাথায় তা ভেঙে পড়ায় সংস্কারের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
ঘড়ি বানানোর অভিজ্ঞতায় সেতু সংস্কার!
সেতু নির্মাণকারী সংস্থা ‘ওরেভা’র ওয়েবসাইটে তাদের নানা কৃতিত্বের কথা লেখা থাকলেও, সেতু নির্মাণ বা সংস্কার সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারা যুক্ত এমন কোনও উল্লেখ সেখানে নেই।
গুজরাটের মোরবী জেলায় মাচ্ছু নদীর উপর সেতুটি ভেঙে পড়ল, তা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ভারবহন ক্ষমতার তুলনায় বেশি লোক উঠে পড়াতেই ভেঙে পড়ে সেতুটি। কারও কারও মতে সেতুটি কাঠামোগত ভাবে মজবুত ছিল না। তবে এ বার এই সেতুটির সংস্কার সংস্থাকে নিয়েই একটি গুরুতর প্রশ্ন উঠে আসল।
সেতুটি সংস্কার করেছে যারা, সেই সংস্থা ‘ওরেভা’ সিএফএল বাল্ব তৈরির জন্যই সারা দেশে বিখ্যাত। বাল্ব ছাড়াও সংস্থাটি ঘড়ি, ইলেকট্রিক বাইক ইত্যাদি জিনিস তৈরি করে থাকে। এই সংস্থার হাত ধরেই ‘অজন্তা’ এবং ‘অরপ্যাটে’র ঘড়ি এই দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ব্যবসা করা এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাঘবজি পটেল। পটেল প্রথমে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন।
এ দিকে স্থানীয় পুরসভার প্রধান আধিকারিক সন্দীপ সিংহ জালা দাবি করেছেন যে, সেতুটিকে তারা কোনও ‘ফিট সার্টিফিকেট’ই দেননি। পুরসভার অনুমতি ছাড়াই গত ২৬ অক্টোবর সেতুটিকে নতুন করে চালু করে দেওয়া হয়। সেতুটি মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই সাত মাস বন্ধ রাখা হয়েছিল। তাই নানা মহল থেকেই এই প্রশ্ন উঠছে যে, কে বা কারা এই সেতু মেরামত করার টেন্ডার সেতু সংস্কারে অনভিজ্ঞ ওই সংস্থাকে দিয়েছিল? সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা।