ঘুষ-দুর্নীতির ৫২ অভিযোগ

89

চট্টগ্রাম বন্দরে ঘুষ, অনিয়ম ও হয়রানিসহ ৫২টি অভিযোগ নিয়ে দুদকের গণশুনানিতে আলোচনা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দরের শহীদ মুন্সী ফজলুর রহমান হলে দুদকের গণশুনানিতে প্রধান অতিথি ছিলেন দুদক কমিশনার (তদন্ত) এএফএম আমিনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, নাগরিকরা এ দেশের মালিক। ২০০৭ সালে দুদক কার্যকর হয়েছে। দুইটি বিষয় দেখে দুদক। একটি প্রতিরোধ, অন্যটি প্রতিকারমূলক। আমরা যে মামলা করি তার ৭৩ শতাংশ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারছি। এ হার শতভাগে নিতে চাই। এ সময় তিনি দেশের মধ্যে যেখানে অনিয়ম-দুর্নীতি, সেখানেই প্রতিরোধ করতে হবে বলে উল্লেখ করে এক্ষেত্রে আরও কঠোর হওয়ার কথা জানান।
দুদকের ১৩৭তম গণশুনানি চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. নুরুল আলম নিজামীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধি ১২-১৪ শতাংশ। যা জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি। প্রধানমন্ত্রী বন্দরের কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বন্দর অটোমেশন পদ্ধতি বাস্তবায়নে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন, বন্দরের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। কমেছে পণ্য পরিবহন খরচ। লয়েডস তালিকায় ৬ ধাপ এগিয়েছে। এটি আইএসপিএস কমপ্লায়েন্স পোর্ট। বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ইয়ার্ডের স¤প্রসারণ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কনটেইনার হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধি সামাল দেওয়া। এর জন্য স্টেক হোল্ডারদের সহযোগিতা চাই।
দুদকের চট্টগ্রামের পরিচালক মাহবুব হাসান বলেন, প্রতিষ্ঠার পর প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক কাজ করে আসছে দুদক। গণশুনানি হচ্ছে সেবাগ্রহীতা ও দাতার মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি।
দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম কমু বলেন, স্বাধীন কমিশন দুদক। দুর্নীতি প্রতিরোধের কাজ স্কুল থেকে শুরু করেছি আমরা। আমরা মনে করি দমনের চেয়ে প্রতিকার শ্রেয়।
গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারী বিজন কুমার খাস্তগীর অভিযোগ করেন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে পেপার ভেরিফাই করার সময় রোটেশন লাইন নম্বর ও আমদানিকারকের নাম ঠিক থাকলেও অহেতুক বিন নম্বর দিয়ে ঝামেলা তৈরি করে। এতে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হয়।
ফারুক অভিযোগ করে বলেন, বন্দরের ৪ নম্বর গেটের ডিটিএম ফারুক ডকুমেন্টে ত্রæটি আছে বলে ঘুষ দাবি করেন। টাকা ছাড়া কোনো কাজ করেন না।
মো. ফয়সাল অভিযোগ করে বলেন, বন্দরের গেট দিয়ে পণ্য বের করার সময় বন্দর সার্জেন্ট ঘুষ দাবি করেন।
নাছির আহমদের অভিযোগ, বিভিন্ন ইয়ার্ডে ক্রেন অপারেটররা পণ্য নামানোর সময় ঘুষ দাবি করেন। ঘুষ না দিলে হয়রানি করেন।
মো. মাহবুবুব আলমের অভিযোগ, এক্সামিন করা পণ্য ডেলিভারি নিতে গেলে এএসআই, সিকিউরিটি লোডিং চেকার কর্তৃক ১০০ টাকা চাঁদার বিপরীতে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। এএসআই শহীদুল কবির ৯০ হাজার টাকার কমে কাজ হবে না জানান।
মাহমুদুল হক অভিযোগ করেন, বন্দরের ভেতরে কনটেইনার লোড করতে হলে নির্ধারিত টাকার বাইরে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়।
এ সময় বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, আপনি টাকা দিয়ে আমার লোকদের খারাপ করছেন কেন। কেউ টাকা দাবি করলে যদি আপনি টাকা না দিতেন, তাহলে কাজ বন্ধ থাকতো। আমি গিয়ে ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতাম।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, আমি সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ চাই। দোষী ব্যক্তিদের মধ্যে দুই-একজনকে শাস্তি দিয়ে সিস্টেম ঠিক করা লাগবে। আগে লুঙ্গি পরে অনেকে বন্দরে প্রবেশ করতেন। এখন লুঙ্গিপরা লোক খুঁজে পাবেন না।
দুদক কমিশনার বলেন, দুর্নীতিবাজ কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা কোথাও তাদেরকে রাখতে চাই না। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে।
এ সময় তিনি কিছু অভিযোগ নিষ্পত্তি করেন, আর কিছু অভিযোগের বিষয়ে বন্দর চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেন।
গণশুনানিতে চন্দন কুমার দে বলেন, এমপিভি গেটে পণ্য ডেলিভারি নিতে গেট সার্জেন্ট ঘুষ দাবি করেন।
তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ইক্যুইপমেন্ট নিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে, টাকা দিলে কাজ হয়, না দিলে কাজ হয় না।
গোলাম মোর্শেদ চন্দন অভিযোগ করে বলেন, বন্দরের অব্যবস্থাপনার অজুহাতে ঢাকাগামী কনটেইনারের কৃত্রিম জট সৃষ্টি করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এভাবে তারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজে নিয়ে আমদানিকারকদের হয়রানি করছেন।
জালাল উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে কনটেইনার ডেলিভারির সময় অযথা সময়ক্ষেপণ করে সংশ্লিষ্টরা। চাহিদা মতো স্পিড মানি না দিলে ডেলিভারি দ্রুত দেওয়া হয় না।
মো. হেলাল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, কনটেইনার ডেলিভারির ক্ষেত্রে কিপ ডাউনে বাড়তি বকশিশ না দিলে কালক্ষেপণ করা হয়।
সৈয়দ রেজাউল করিমের অভিযোগ, ১২ নম্বর শেডে একটি চালানে লক কাটা ছিল। ২টি ল্যাপটপ পাওয়া যায়নি।
সুমন অভিযোগ করেন, ডিটিএম ভবনের জসিম ডেলিভারি নিতে গেলে সরকারি রশিদ ছাড়া ২০০-৫০০ টাকা নেন। টাকা ছাড়া তিনি কোনো কাজ করেন না।
গোলাম কবির বলেন, ডেলিভারি পয়েন্টে সিকিউরিটির দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারীরা চাঁদা ছাড়া কোনো কাজ করেন না।
গণশুনানিতে বন্দরে আমদানি পণ্য বা কনটেইনার নামার ৪৫ দিনের মধ্যে নিলামে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাস্তবে এ প্রক্রিয়াটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ফলে নিলামযোগ্য ৬ হাজারের বেশি কনটেইনারের জট তৈরি হয়েছে। এই বিষয়টি গণশুনানিতে তুলেছেন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএএ) পরিচালক শাহেদ সরওয়ার। এ সময় তিনি বন্দরের গেট পাসে পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়টি বাতিল বা সহজীকরণের দাবি জানান।