ঘুরে এলাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এর সংগ্রহশালা

15

 

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পথিকৃৎ এই চিত্রকর দীর্ঘ ছ’মাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে মাত্র ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন । তাঁর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি শিল্পের পথে নিবেদিত একজন ব্যক্তি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় ও সুস্থ মননসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জীবনকর্মসহ দেশের অতীত ঐতিহ্য, চিত্রশিল্প গুরুত্ব বহন করে। তাই প্রথম বারের মতো ময়মনসিংহ যাওয়া সাপেক্ষে এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা ঘুরার সুযোগ হলো আমার। সংগ্রহশালার পরিচালকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম প্রতি বছর দেশ বিদেশের প্রচুর পর্যটক শিল্পাচার্য এর সংগ্রহশালায় ঘুরতে আসেন। ময়মনসিংহ শহরের উত্তর পাশ দিয়ে প্রবহমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি দোতলা দালানকে আশ্রয় করে ১৯৭৫ সালে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি জাতীয় জাদুঘর পরিচালিত সংগ্রহশালা। ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন। সে সময় দেশব্যাপী জয়নুল আবেদিনের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়। আর তাই প্রথম দিকেই শিল্পীর নিজের এলাকা তথা মযমনসিংহে এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৬ সালে সংগ্রহশালাটি নতুন করে সাজানো হয়। বাড়ির নিচতলায় ব্যবস্থাপনা কক্ষসমূহ ও দোতলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছবির গ্যালারি স্থাপন করা হয়। দোতলা ভবনবিশিষ্ট যে জমিতে এটি অবস্থিত তার আয়তন ৩.৬৯ একর। এই সংগ্রহশালায় প্রথমে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ৭০টি চিত্রকর্ম স্থান পায়, যার বেশির ভাগই তৈলচিত্র। উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে-বিভিন্ন দেশ ভ্রমণকালে শিল্পাচার্যের অঙ্কিত ছবি, গুণটানা, নদী পারাপারের অপেক্ষায় পিতা-পুত্র ও দুর্ভিক্ষ। বর্তমানে এখানে ৬৩টি চিত্রকর্ম রয়েছে। এছাড়া রয়েছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত জিনিস ও তার কিছু স্থিরচিত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃহত্তর ময়মসিংহ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বলয়ের সৃষ্টি তথা এখানে বসবাসকারী মানুষ, নতুন প্রজন্ম, পর্যটকসহ সবাইকে এই অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করা এবং এখানকার ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য এই সংগ্রহশালার গুরুত্ব অপরিসীম। নতুন ডিজাইনে এই সংগ্রহশালার আয়তন দাঁড়াবে ২ লাখ ৪০,০০০ বর্গফুট। এতে শিল্পাচার্যের চিত্রকর্মের গ্যালারি ৪টি, তার সংগৃহীত, ব্যবহার্য ও অর্জিত নিদর্শনের গ্যালারি ২টি, শিল্পাচার্যের আলকচিত্রের গ্যালারি ১টি, সমকালীন শিল্পীদের গ্যালারি ২টি, বিশ্বসভ্যতার গ্যালারি ২টি, ময়মনসিংহের লোকশিল্প নিদর্শনের গ্যালারি ২টি, সাময়িক প্রদর্শনী গ্যালারি ২টি। একই সঙ্গে দর্শকদের জন্য ৫০০ আসনবিশিষ্ট অডিটোরিয়ামসহ ২০০ আসনবিশিষ্ট সেমিনার রুম রাখা হয়েছে। অধিক জায়গা নিয়ে গ্যালারির জায়গাগুলোকে প্রসারিত করা হয়েছে। যেখানে আধুনিক উপায়ে অধিক সংখ্যক প্রদর্শনীর আয়োজন করা যাবে। সংগ্রহশালার প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে স্টুডিও যা সরাসরি পরিবেশনার জন্য প্ল্যাটফরম তৈরি করবে। মূল সংগ্রহশালার তৃতীয়তলা সাজানো হয়েছে শিক্ষণীয় সৃজনশীল ল্যাব দিয়ে যা দর্শনার্থীদের বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। সংগ্রহশালার নিচতলায় রাস্তাসংলগ্ন গ্যালারিগুলোও সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসসংলগ্ন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা এলাকায় একটি পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থী এই পার্কে ঘুরতে আসেন। এখানে সংগ্রহশালার মূল নকশা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যা ক্রমান্বয়ে দর্শনার্থীদের কাছে বিভিন্ন কার্যকলাপের স্থান হিসাবে উন্মুক্ত হয়। নকশায় মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ করার পর প্রথম যে স্থাপনাটি উন্মুক্ত হয় তা হলো পানিতে ভাসমান ভাস্কর্য সংবলিত উন্মুক্ত আঙিনা যার এক পাশে আর্ট স্কুল, তারপর রয়েছে উন্মুক্ত জায়গা, ক্যাফেটেরিয়া ও কফি শপ, গ্যালারি, অডিটোরিয়াম এবং সেমিনার রুম, গ্রন্থাগার। ময়মনসিংহ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবহুল দেয়ালচিত্র বা মুর‌্যাল সংবলিত একটি উন্মুক্ত ভাস্কর্য আঙিনা রাখা হয়েছে যা দর্শনার্থীদের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেবে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক