ঘুম ও স্বপ্ন

70

 

এক
শ্যামলপুর বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক শাহাজাহান আলী খন্দকার। গ্রামের সবাই তাঁকে হেড স্যার বলে ডাকেন। বাসুদেব মন্ডল হেড স্যারের সামনের চেয়ারে বসে আছেন। হেড স্যার কী যেন লিখছেন। হাতের কাজ শেষে, তিনি কাগজটা ভাঁজ করলেন। ভাঁজ করা কাগজটিকে বল বানিয়ে ফেললেন। এরপর পান মুখে দিয়ে বললেন- বহুকষ্টে সিগারেট ছেড়েছি, মানে নিকোটিন থেকে দূরে আছি। কিন্তু পান ছাড়তে পারি নাই।
হেড স্যার পানের বোঁটায় বেশকিছু চুন লাগিয়ে বললেন- বেশ কিছুদিন ধরে গ্যাসট্রিক, মানে এসিডিটি বেড়েছে। চুন খেলে কী কমবে? আপনার বিজ্ঞান কী বলে ?
বাসুদেব মন্ডল থতমত খেয়ে বললেন- তা ঠিক বলতে পারব না, তবে এসিড ও চুনের বিক্রিয়ায় প্রশমন বিক্রিয়া ঘটার কথা। ছোট বেলায় দিদিমাকে গ্যাসট্রিকের জন্য খাবার সোডা খেতে দেখেছি।
হেড স্যার হেসে বললেন – ছোট বেলার কথা বড় বেলাতেও মনে আছে ? দিদিমার আর কোন কথা মনে পড়ে ?
বাসুদেব মন্ডল একটু হেসে বললেন- দিদিমা সুযোগ পেলেই তাঁর রূপের গুণগান করতেন। ৩২ ঘরে দেখার পর ৩৩ ঘরে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি যে পন্ডিতের মেয়ে, প্রায়ই লোকজনকে মনে করিয়ে দিতেন। এই নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল। প্রতি শেষ রাত্রিতে নমদাদা আর দিদিমা শুয়ে শুয়ে গল্প করতেন। নমদাদা থাকতেন ছোট একটা চৌকিতে, দিদিমা থাকতেন নিচে পাটি বিছিয়ে। গল্পের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসত ইন্ডিয়ায় তীর্থ ভ্রমণ। আর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্থানী মিলিটারীর ভয়ে ঘর ছেড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়ানো। দিদিমা ইন্ডিয়াকে বলতেন ইঞ্জিয়া, আর মিলিটারীকে মিমেটারী।
বেশ খানিকক্ষণ দু’জনেই মৌন। বাসুদেব মন্ডল কিছুটা অস্বস্থি বোধ করছেন। আসলে হেড স্যার কী বলতে চাচ্ছেন সেটাই ধরতে পারছেন না। ক্লাসের আগে নিশ্চয়ই তিনি গল্প করার জন্য ডাকেন নাই।
এক সময় হেড স্যার বলের মত ভাঁজ করা কাগজটা ঠেলে দিয়ে বললেন- কাগজটা নিয়ে যান। ক্লাশের সময় হয়েছে। পরে, পড়ে দেখবেন।
কাগজটি পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বাসুদেব মন্ডল রুম থেকে বের হয়ে এলেন।
টিফিন ছুটির বিরতী চলছে। বাসুদেব মন্ডল কাগজটা বের করে ভাঁজ খুললেন। কাগজটাতে লেখা আছে- একটা ছোট অংক দিলাম। অংকটাতে পরিসংখ্যানের ব্যবহার আছে। আচ্ছা মিথ্যা কয় প্রকার যেন ? মনে পড়েছে ! তিন প্রকার। তার মধ্যে পরিসংখ্যান একটি। হা! হা! হা! ……। একটু রসিকতা করলাম। এবার কাজের কথায় আসি। নিচে ছোট একটা সমস্যা দিলাম।
হেড স্যারের সমস্যাটা অনেকটা সৃজনশীল মার্কা। উদ্দীপক হিসেবে বাংলাদেশের মানচিত্র । তার একেবারে উপরে ও নিচে দুইটি বিন্দু। নিচের বিন্দুটি ‘ক’ চিহ্নিত, আর উপরেরটি ‘খ’ চিহ্নিত। ‘ক’ চিহ্নিত স্থানে একটি স্কুটার, মানে যন্ত্রচালিত দ্বিচক্রযান। স্কুটারের অভিমুখ ‘খ’ এর দিকে। মানচিত্রের নিচে লেখা আছে- সতের’শ লিটার পেট্রোলে ‘ক’ ও ‘খ’ চিহ্নিত স্থান দুইটিতে কয়বার আসা-যাওয়া করা যাবে?
বাসুদেব মন্ডল সমস্যাটি নিয়ে একটু ভাবলেন। স্কুটার চলছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। তাহলে ‘ক’ হচ্ছে টেকনাফ, আর ‘খ’ হচ্ছে বাংলাবান্ধা। তার মানে সমস্যাটি হচ্ছে- সতের’শ লিটার পেট্রোলে একটি স্কুটার টেকনাফ থেকে বাংলাবান্ধা কয়বার আসা-যাওয়া করতে পারবে? বিড়বিড় করে বললেন-ইউরেকা, ইউরেকা।
বাসুদেব মন্ডল তাঁর পাশের দেয়ালের মানচিত্রে চোখ বুলালেন। এরপর কাগজটিকে পকেটে ঢুকালেন। তিনি বসে আছেন সুকান্তের কায়দায়। সুকান্ত বাসুদেব মন্ডলের প্রিয় কবি।
শ্যামলপুর বিদ্যানিকেতনে প্রতিবছর আগষ্টে সুকান্তের জন্মজয়ন্তী হয়। সেই অনুষ্ঠানে তিনি প্রতিবছরই আবৃত্তি করেন ছাড়পত্রের শেষ অংশ। “এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে স্থান……” । এবারে আবৃত্তি করেছেন- হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়/এবার কঠিন, কঠোর গদ্য আনো,/ পদ-লালিত্য ঝঙ্কার মুছে যাক/ গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!/প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা-/কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,/ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। আবৃত্তি শেষে সুকান্তের ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন- সুকান্ত তাঁর এই ছবিটি খেয়ালের বশে তুলেছিলেন। দুপুরে এক বন্ধুকে হোটেলে নিয়ে ভুরি ভোজ করলেন। তারপর স্টুডিওতে ছবিটা তুললেন। তাঁর ২১ বছর জীবনের এই ছবিটা স্মৃতি হয়ে আছে।
বাসুদেব মন্ডলের পাশের চেয়ারে বাংলার শিক্ষক ইমরান শেখর বসতে বসতে বললেন- আজকে নাকি টু মুন নাইট ? আকাশে কী মঙ্গলের মত দুইটি চাঁদ দেখা যাবে ? ডিমোস ও ফোবস টাইপের?
বাসুদেব মন্ডল তাঁর দিকে এমনভাবে তাকালেন, যা বুঝিয়ে দেয়- আপনিতো ভালই জানেন টু মুন মানে এক মাসে দুইটি পূর্ণিমা।
ইমরান শেখর হেসে বললেন- দেখেন তো সপ্তর্ষি মন্ডলের তারাগুলোর নাম ঠিক আছে কিনা ? ক্রুতু, পুলহ, পুলস্ত, অত্রি, অঙ্গিরা, বশিষ্ট ও মরীচি।
বাসুদেব মন্ডল কিছুই বললেন না। তিনি আগের ভঙ্গিতেই তাকিয়ে আছেন।
ইমরান শেখর বললেন- কী ব্যাপার। আমি একজন আকাশচারীর কাছে আকাশ নিয়ে বকবক করে যাচ্ছি, আর আকাশচারী মৌন? হ্যাঁ-না কোন রা নাই।
বাসুদেব মন্ডল মৌনতা ভেঙ্গে বললেন- ভাবছি দেশ ভ্রমণে বের হব।
-বেশ ইন্টারেস্টিং। হঠাৎ আকাশচারী থেকে দেশচারী হওয়ার ইচ্ছা ? তা কোথায় যাবেন ?
-স্কুটারে করে টেকনাফ থেকে বাংলাবান্ধা। দক্ষিণ থেকে উত্তরে।
-অ্যাঁ, স্কুটারে ! টেকনাফ থেকে বাংলাবান্ধা? দূরত্ব কত জানেন ? মাঝখানে কয়টি জেলা, হিসাব আছে?
-না, এতসব জানি না। তবে অসুবিধা নাই। দেশচারী আপনি আছেন না। আমি চালাব স্কুটার, আর আপনি থাকবেন আমার পিছনে হা!, হা!, হা!
-বুঝেছি আপনার মাথায় কোন খেয়াল চেপেছে। আপনি আপনার খেয়ালীপনা ভাবনায় থাকুন, আমি বরং বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসি।
ইমরান শেখর চেয়ার ছেড়ে যেতে যেতে বললেন- টেকনাফ আর বাংলাবান্ধা জায়গা দুইটি খুবই সুন্দর। নাফ নদীর পাড়ে টেকনাফ আর করতোয়া পেরিয়ে পঞ্চগড়ের শেষ সীমানায় মহানন্দার পড়ে বাংলাবান্ধা। বাংলাবান্ধায় কিলোমিটার ফলকে দেখেছি টেকনাফ ১০৭৪ কিলোমিটার। আর পথে পড়বে কক্সবাজার, বান্দরবন,চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ঢাকা, টাঙ্গাইল, শেরপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, পঞ্চগড় প্রায় ষোলটি জেলা।

দুই
টিভি অন। সন্ধ্যার খরব হচ্ছে। হেড স্যার টিভি সেটের সামনে বসে আছেন। খবরের দিকে তাঁর মনোযোগ নাই। তিনি তাকিয়ে আছেন ফ্যানের দিকে। ফ্যানের দিকে তাকালে তাঁর প্রায়ই রহমত পাগলার কথা মনে পড়ে যায়। এখনও তাই ঘটছে।
রহমত স্কুলের সামনের রাস্তায় বটগাছ তলে গরম কাপড় গায়ে, মাথা নিচু করে বসে আছে। অন্যদিন হেড স্যারকে দেখা মাত্রই দূর থেকে সালাম দেয়। সেদিন দিল না। হেড স্যারস্কুলইেযাচ্ছিলেন। রহমতকে জিজ্ঞেস করলেন- কী রহমত, ঠান্ডা কী বেশী পড়ছে ? রহমত মাথা তুলে, হেড স্যারের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর দার্শনিকের মত বলল- হ, স্যার । বেশ ঠান্ডা। ভাবছি এই ঠান্ডারে গরমের লাগি যদি, রাখি দিতে পাইরতাম।
রহমত পাগলার কথা মনে আসায় হেড স্যার হাসছেন। মনে মনে ভাবছেন বাসুদেব মন্ডলের মাথায় এমন একটি প্রজেক্ট ঢুকিয়ে দিলে, বেশ ভালই জমবে। মানুষটা নানান বিষয় নিয়ে ভাবেন, কিন্তু ফিনিশিংটা হয় না। এই সীমাবদ্ধতা তাঁর জ্ঞাত। এই স্বপ্নবাজ মানুষটির বহুল প্রচলিত একটি উক্তি হচ্ছে – “স্বপ্ন ও ভাবনা মহত্তম সৃষ্টির বীজ। আকাশে উড়ার স্বপ্ন থেকে মহাকাশযানের সৃষ্টি।” এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুললেন হেড স্যার। খুলেই বাসুদেব মন্ডলকে দেখে কিছুটা বিস্ময় ও উত্তেজনা নিয়ে বললেন- কী কাকতালীয় ব্যাপার ? মনে মনে আপনার কথাই ভাবছিলাম। এটাই কী ট্যালিপ্যাথি ? আসুন, আসুন ভিতরে আসুন।
-আজ আসব না। দুইটি জরুরী প্রশ্ন আছে, স্যার। উত্তর জেনেই চলে যাব।
-প্রশ্ন ?
-সমস্যাটি কী আপনার স্যার ?
-কোন সমস্যা ?
-সকালে যে কাগজটা দিয়েছিলেন, তার কথা বলছিলাম।
-ও হ্যাঁ। আমারই, আবার আমার না। মানে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার সবুর হোসেন বিলু পাঁচ মাসে এক স্কুটারের জন্যে ১৭০০ লিটার তেল খরচ করেছে।
-আচ্ছা, ম্যানেজারের খরচপাতি কে দেখাশুনা করেন?
-আগে আমিই করতাম। পাঁচ-ছয় মাস ধরে আমার ছেলে করছে ।
– উত্তর পেয়ে গেছি। আসি স্যার।
হেড স্যার কিছু বলার আগেই বাসুদেব মন্ডল হাঁটা শুরু করলেন। ডাকার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পিছন থেকে আর ডাকা হল না। তিনি সংস্কার মানেন।

তিন
বাসুদেব মন্ডল সত্যি সত্যি টেকনাফ থেকে বাংলাবান্ধা যাবার জন্য স্কুটার জোগাড় করেছেন। স্কুটারটি তাঁর এক ছাত্রের মামার। স্কুটারের গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৪০ কিলোমিটার। আর এক লিটার পেট্রোলে নাকি ৫০ কিলোমিটার যেতে পারে।
রাত্রের খাওয়া দাওয়া একটু আগেই সারলেন বাসুদেব মন্ডল। খাওয়া শেষে তাঁর“আফটার সাপার ওয়াক এ মাইল” এই নীতি মানা হল না। তিনি বসেছেন কাগজ-কলম নিয়ে। তিনি হিসাব করে দেখলেন তাঁর জোগার করা স্কুটার দিয়ে ৩৯ বার টেকনাফ থেকে বাংলাবান্ধা আসা যাওয়া করতে পারবে, সময় লাগবে তিন মাস। থেমে গেছে কলম। ঘোর লাগা ভাব। নিউরণ ঘুম চাচ্ছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে। ডায়রীতে ঘুম ও স্বপ্ন নিয়ে তাঁর একটি লেখা আছে। লেখাটি হচ্ছে-
সাধারণত দুইজন মানুষের বেশ কিছু ঘুম পায়। একজন ক্লান্ত, আরেক জন সুখী। ক্লান্ত মানুষের ঘুম মধ্যম গাঢ়। ঘুম শেষে থেকে যায় অতৃপ্তি। আর সুখী মানুষের ঘুম গাঢ়, ঘুমে থাকে তৃপ্তি। এই দুইজন মানুষের স্বপ্ন গতানুগতিক, সাদা-কাল। আবার যিনি একই সাথে ক্লান্ত ও সুখী তাঁর ঘুম উচ্চ মধ্যম গাঢ়। আবার লঘুও হতে পারে। তাঁদের স্বপ্ন রঙিন, বৈচিত্রময়। তাঁরা স্বপ্নে ঘুরতে থাকে দেশ থেকে দেশে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। তাঁদের স্বপ্নে যখন মিথ্যার ছোঁয়া লাগে, তখন স্বপ্ন থেমে যায়। ঘুম যায় টুটে। আর স্বপ্ন যখন সত্য, তখন ঘুম হয় নিরবিচ্ছিন্ন। যদিও প্রকৃতি বলছে নিরবিচ্ছিন্ন বলে কিছু নেই, সব কোয়ান্টামিত। আবার সুখ আর ক্লান্তি, এইসব খুবই আপেক্ষিক। আসলে মহাবিশ্বের সবকিছুই আপেক্ষিক।
বাসুদেব মন্ডল ঘুমিয়ে গেছেন। তবে বিছানায় নয়, বসা অবস্থায় টেবিলে মাথা রেখে। তিনি স্কুটার চালিয়ে ছুটছেন, টেকনাফ থেকে বাংলাবান্ধার দিকে। রাস্তার মাঝে মাঝে ইট সুরকি উঠে গেছে, থেকে থেকে বাঁক, তাই স্কুটারের গতি কমে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও জ্যামে পড়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। সবচেয়ে বড় জ্যাম লেগেছে কুমিল্লায়। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে। জ্যাম ছুটে গেছে, কিন্তু স্কুটার স্টার্ট নিচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলি করার পর স্কুটার স্টার্ট নিয়েছে। নীলফামারীতে স্কুটার উল্টে গেছে। লোকজন ছুটে এসেছে। নানাজন নানাভাবে সেবা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে-পথে পথিকই স্বজন। অবশেষে স্কুটার এসে পৌঁচেছে করতোয়ার পাড়ে। স্কুটার আপনা আপনি থেমে গেছে। অনেক ঠেলাঠেলি করা হল, কোন কাজ হল না। করতোয়ার শান্ত নির্মল বাতাস। তবু তাঁর গরম লাগছে। কোত্থেকে সবুর হোসেন এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার হাতে ক্র্যাচ কেন? সব মিলিয়ে কাজ করছে অস্বস্তি। অস্বস্তি নিয়ে ঘুমানো যায় না। ঘুম ভেঙ্গে গেল।
বাসুদেব মন্ডল চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। তিনি স্বপ্নটার ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার চেষ্টা করছেন।
“একটানা হাজার কিলোমিটার স্কুটার চালিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টের। স্বপ্ন এই কষ্টের, সত্যের স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু পাঁচ মাসে ১৭০০ লিটার পেট্রোল একটি মহাখাদক স্কুটারও খেতে পারবে না। তার মানে ম্যানেজার সবুর হোসেন বিলু মিথ্যা বলেছে। স্বপ্ন এই মিথ্যাকে ধরতে পেরেছে। তাই স্বপ্ন করতোয়ার পাড়ে থেমে গেছে। কিন্তু ক্র্যাচ হাতে সবুর হোসেন কেন? প্রকৃতি কী তাকে কোন শাস্তি দিবে? স্বপ্নে অনেক সময় ভবিষ্যৎ দেখা যায়।” তিনি খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর একটি কাগজে সুন্দর করে লিখলেন-
স্যার, আপনি ভাল করে জানেন আপনার ম্যানেজার মিথ্যা বলেছে। শুধু মিথ্যা না, ডাহা মিথ্যা। সবুর হোসেনের শেষে বিলু নামটা আপনি জুড়ে দিয়েছেন। বিড়ালের সংক্ষিপ্ত রূপ করেছেন বিলু। বিড়াল পাতিল মারে উদর পূরণের জন্য। আর আপনার বিলু পাতিল মারে জ্যামিতিক হারে টাকার স্তুপ বানানোর জন্য। আপনার প্রশ্রয় বা অনুকম্পায় সবুর হোসেন বিড়াল থেকে হয়ে গেছে নেকড়ে। তাহলে কী বিলু হয়ে যাবে নেড়–? যাই হোক, তার এই রূপান্তর তাকে বেপরোয়া করেছে। তাই সে এক স্কুটারের জন্য পাঁচ মাসে তিন স্কুটারের বেশি টাকা খরচ করেছে। প্রায় ১৭০০´৯৬ টাকা=১৬৩২০০ টাকা। এই টাকার কিছু অংশ আপনার ছেলে মেরে দিয়েছে। কারণ টাকার উত্তাপ সহজে ছড়ায়, যা আপনার ছেলের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। আপনার ম্যানেজারের চারিত্রিক দোষও আছে। সেদিন কথায় কথায় বলেছিলেন-“কারণ ছাড়া বিলুর ঘরে বুয়ার ব্রা চলে যাচ্ছে, বুয়ার ¯œানের সময় আশেপাশে ঘুরঘুর করে। তাছাড়া বেটা বুয়াকে সস্তা দামের কড়া কসমেটিকও দেয়। কী করা যায় বলুন তো?” আমার মনে হয়, আপনার ম্যানেজার মদেও আসক্ত। কথায় বলে-মদ, মুদ্রা, মৈথুন এই তিন ‘ম’ এক সাথে থাকে। আপনি এসবের সবই জ্ঞাত আছেন। আপনার অনেক বিষয় আমার সাথে শেয়ার করেন। এখনও হয়ত তাই করতে চাচ্ছেন। তাই ছোট একটা পরামর্শ দিই। তবে পরামর্শের জন্য অপরাধ নিবেন না। পরামর্শটি হচ্ছে- আপনার ম্যানেজারকে ১০১ বার কান ধরে উঠ বস করিয়ে, মাথায় ঘোল ঢেলে দিন। পারলে মাথা ন্যাড়া করিয়ে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিন। তারপর চাকরী ডিসমিস করে দেন। ছেলের ব্যাপারে সিদ্ধান্তটি আপনি নেন। তবে অনুরোধ থাকবে তার ক্ষমতা চিস করে নিবেন।
এবার আপনার প্রদত্ত সমস্যার একটা গড় হিসাব দিই। ১৭০০ লিটার পেট্রোলে একটি স্কুটার টেকনাফ থেকে বাংলাবান্ধা ৩৯ বার যাওয়া আসা করতে পারবে। আর সময় লাগবে ২১২৫ ঘন্টা অর্থাৎ প্রায় ৮৮ দিন মানে তিন মাস।
লেখা শেষে, বেশ হালকা অনুভব হচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। চেহারায় প্রসন্ন ভাব। সুখানুভব ছড়িয়ে পড়েছে চোখে মুখে। তিনি ঘুমাতে গেলেন।
এই ঘুমে তিনি কী কোন স্বপ্ন দেখবেন ? হয়’ত দেখবেন। তাঁর ভাষায় সেই স্বপ্ন হবে গতানুগতিক, সাদাকালো।