ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ নগরজীবন

118

আবারও ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। দিন কিংবা রাত নয় যে কোনো সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। গতকাল দিনভর এমনিতেই তীব্র গরম পড়েছে, অন্যদিকে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। কোনো আগাম নোটিশ ছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে হঠাৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ফলে জাতীয় গ্রিডও বিদ্যুৎ সংকটে পড়ে। যার কারণ হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ রাখা। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, কোনো লোডশেডিং হচ্ছে না; রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য সাময়িক বন্ধ রাখা হচ্ছে।
গত কয়েকদিন ধরে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে থেমে থেমে লোডশেডিং হচ্ছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকায়ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। শহরের চেয়ে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি শোচনীয় পর্যায়ে।
গতকাল রবিবার বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড’র (বিপিডিবি) ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, সারাদেশের বিদ্যুতকেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী ১২ হাজার ৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিনের বেলায় উৎপাদন হয়েছে এবং ১৪ হাজার ৪২৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সন্ধ্যাকালীন উৎপাদন হয়। তার আগের দিন অর্থাৎ ২০ জুলাই দিনের বেলায় উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ৫৪৫ দশমিক ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং সন্ধ্যাকালীন উৎপাদন হয় ১২ হাজার ১৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
পিডিবি চট্টগ্রাম সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম জোনে (পল্লী বিদ্যুৎ বাদে) বিদ্যুতের গ্রাহক রয়েছে ১০ লাখ ৯০ হাজার আর চাহিদা রয়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আবার চট্টগ্রামের তিনটি সমিতি মিলিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক রয়েছে ১১ লাখ। আর চাহিদা রয়েছে ৩০০ থেকে ৩৫০ মেগাওয়াট।
এছাড়া দিনের বেলায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চালু থাকলে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। কিন্তু বিকেল পাঁচটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পিক আওয়ার সময়ে তা ১ হাজার ২০০ পর্যন্ত হয়ে যায়।
জনমনে প্রশ্ন, পিডিবিসহ অন্যান্য সকল সংস্থা বিদ্যুৎ সংগ্রহ করে জাতীয় গ্রিড থেকে। আর জাতীয় গ্রিডে তো বিদ্যুৎ সংকট হওয়ার কথা না। কারণ প্রধানমন্ত্রীর ভিশন অনুযায়ী দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে আর তা বিতরণও হচ্ছে তাহলে লোডশেডিং কেন হবে?
এদিকে গত ৮ জুলাই প্রবল বর্ষণের সময় হাটহাজারীর এগার মাইলে ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের বিষাক্ত বর্জ্য পাশের ছড়ায় ছেড়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তারা জানান, প্ল্যান্টের বর্জ্য হালদায় পড়ে মাছ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীন ঘটনাস্থলে গিয়ে দূষিত বর্জ্যের ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন। এরপর বিষয়টি পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। এছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরকে লিখিতভাবে জানান। পরে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দূষণের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। তারপর ১৭ জুলাই বিদ্যুতকেন্দ্রটিকে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ধারা ৭ অনুযায়ী ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এছাড়া বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করে বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট সময়ও বেধে দেওয়া হয়। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মুক্তাদির হাসান।
এ পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করার পর থেকে চট্টগ্রামসহ তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় লোডশেডিং এর প্রভাব পড়ে। চট্টগ্রাম মহানগরীতেও একদিনে প্রায় দুই ঘণ্টার মত লোডশেডিং হয়েছে। তবে কোন সময় বেশি, আবার কোন সময় কম। পার্বত্য এলাকা খাগড়াছড়িতে থেমে থেমে দৈনিক তিন থেকে চার ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির কয়েকটি উপজেলায় বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্ক দুর্বল হওয়ার ফলে দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে কিন্তু শহর এলাকায় তেমন লোডশেডিং হচ্ছে না।
এদিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলায়ও বিরতি দিয়ে লোডশেডিং হয় দৈনিক দুই ঘণ্টার মত।
নগরীর হালিশহর এলাকার স্কুল ছাত্রী শাহী নুর তাজ আদিবা বলেন, সন্ধ্যার পর যখন পড়তে বসি, তখন বিদ্যুৎ চলে যায় আবার কিছুক্ষণ পর আসে। মাঝে মাঝে শুনি বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে গেছে। তখন বিদ্যুৎ আসতে একটু বেশি সময় লাগে।
কদমতলী এলাকার সোহেল রানা বলেন, রাতে কাজ শেষ করে বাসায় গেলাম। তখন দেখি বিদ্যুৎ নেই। প্রায় একঘণ্টা পর আসে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চলে যাওয়াটা খুবই বিরক্তি লাগে।
ষোলশহর এলাকার আবছার উদ্দিন বলেন, সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা বলছে। তাহলে শতভাগ লোডশেডিং মুক্ত করতে পারছে না কেন। সরকার নজর দিলে শতভাগ লোডশেডিং মুক্ত করতে পারবেন।
হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী শফিউদ্দিন আহমেদ জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আমাদের নিজস্ব সম্পদ নয়, এটি দেশের সম্পদ। এ কেন্দ্র থেকে যে বর্জ্য ছাড়া হয়েছিল, তা অতি সামান্য। হয়তো কোন একদিকে ছিদ্র হয়ে বর্জ্যগুলো ছড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এটিকে বলা হয়েছে আমরা রাতের আঁধারে বর্জ্য ফেলে নদী দূষণ করছি।
পিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন পূর্বদেশকে জানান, হাটহাজারী বিদ্যুতকেন্দ্রটি বন্ধের ফলে শুধু হাটহাজারী কেন বাংলাদেশের কোথাও এর প্রভাব পড়বে না। দেশে এখন চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে এবং আমাদের অন্যান্য সকল বিদ্যুতকেন্দ্র সচল রয়েছে। শুধুমাত্র একটি কেন্দ্র বন্ধ থাকলে লোডশেডিং হবে- এটি আমি মানতে পারছি না।
তাহলে লোডশেডিং কেন হচ্ছে প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি যতটুকু জানি। যখন কোন এলাকায় রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয়, সেখানে পুরো এলাকায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। পাবলিক একে লোডশেডিং মনে করছে। আসলে আমাদের পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ রয়েছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকার কারণে আমরা কয়েকটি কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ করে দিই।