গোয়েন্দা নজরদারির সুপারিশ চিনির মজুদদারীর বিরুদ্ধে

6

পূর্বদেশ ডেস্ক

চিনির বাজার বেশ কিছুদিন ধরেই অস্থিতিশীল। খোলা বাজারে প্যাকেটজাত চিনিরও সংকট। সংকটের কারণ খুঁজতে দেশব্যাপী অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। মিল মালিকরা গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা বলছেন। এছাড়া চিনি ব্যবসায়ী, মিল মালিক, খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে সংস্থাটি। কিন্তু তা থেকে কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায়নি। তাই কোনো অসাধু চক্র চিনি মজুদ করছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে সুপারিশ করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে মিল পর্যায়ে এবং খুচরা, পাইকারি ও ডিলার পর্যায়ে কিছু অসঙ্গতির কথা বলা হয়। চিনির মিলগুলোতে মজুদকৃত চিনি পাওয়া যায়নি, তবে সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন, সাপ্লাই অর্ডারে মূল্য না লেখাসহ কয়েকটি অসঙ্গতির বিষয় পাওয়া গেছে। মেঘনা সুগার রিফাইনারির ৩ হাজার মেট্রিক টন সক্ষমতা থাকলেও ২০ অক্টোবর তারা ১ হাজার ৯৭৪ মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন করেছে। সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ উৎপাদনের সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশ কম উৎপাদন করেছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা উল্লেখ করা হয়। আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারির সক্ষমতা ৭০০ মেট্রিক টন সক্ষমতা হলেও ২২ অক্টোবর ৬৮৫ মেট্রিক টন উৎপাদন ও সরবরাহ করেছে। এস আলম সুগার রিফাইনারি প্রতিদিন ৮০০-৯০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করছে। তাদের উৎপাদিত চিনির ৫০ কেজির বস্তায় ক্রয় মূল্য লেখা থাকলেও বাজারে তা পাওয়া যায়নি। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
বাজার তদারকি করে সংস্থাটি জানতে পারে, সরকার নির্ধারিত মূল্যে বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে না, আর সরবরাহ তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়া প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ কম এবং কোথাও কোথাও প্যাকেটজাত চিনি খুলে বিক্রি করা হচ্ছে বেশি দামে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, মিল গেট কিংবা খাতুনগঞ্জ ও মৌলভীবাজার থেকে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে চিনি। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারদের কাছ থেকে বেশি দামে চিনি কিনতে হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা চিনি বিক্রির ভাউচার দেন না, ভাউচার দিলেও তাতে চিনির পরিমাণ লেখা থাকে কিন্তু মূল্য না। পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- ডিলারদের কাছ থেকে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। দুই মাস আগের অর্ডার দেওয়া চিনি এখনও পাননি তারা।
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ শফিকউজ্জামান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দুই দফা মতবিনিময় সভা করেছেন। সভা করে তিনি জানান, অপরিশোধিত চিনির মজুদ ও পাইপ লাইনে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৫ মেট্রিক টন চিনি মজুদ আছে এবং চিনির কোনো ঘাটতি নেই।
চিনির বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে সাতটি কারণ দেখছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এর মধ্যে আছে উৎপাদন ও সরবরাহ কম, পাকা ভাউচার না দেওয়া, এলসি খোলার জটিলতা, মিল গেটে ট্রাকে চিনি লোডের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় জটিলতা, ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব, শুল্কহারের সমন্বয়, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ-২০১১ এর ‘ফরম ঘ’ অনুযায়ী, সাপ্লাই অর্ডারে একক মূল্য উল্লেখ না করা।
প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে আছে- মিলগুলোকে তাদের সর্বোচ্চ উৎপাদন এবং সরবরাহ অব্যাহত রাখার নির্দেশনা প্রদান, মিল থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত কোথাও অসাধু উদ্দেশ্যে চিনি মজুদ করে বাজার অস্থিতিশীল করছে কিনা, গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক তা নজরদারি করা, চিনির বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট/বাজার অভিযান অব্যাহত থাকতে হবে, মূল্য পর্যালোচনার জন্য ‘মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’র নিয়মিত সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, চিনি উৎপাদনকারী মিলগুলোতে নির্ধারিত চাপের গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, মিল মালিক থেকে খুচরা পর্যায়ে ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মুদ্রিত (পাকা) ভাউচার প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, এলসি খোলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান জটিলতা দূর করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক ব্যবসায়ীদেরকে সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশনা, মিলগেট হতে চিনি পরিবহনে (ট্রাক) সরবরাহ করতে অপেক্ষমান সময় কমিয়ে আনতে হবে, এলাকাভিত্তিক ডিলার নির্ধারণ করে সেই ডিলারদের মাধ্যমে এলাকার বাজারগুলোতে চিনি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, মিলগুলো কর্তৃক অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ-২০১১ এর ‘ফরম ঘ’ অনুযায়ী, সাপ্লাই অর্ডারে চিনির একক মূল্য উল্লেখ করতে হবে, ঢাকাসহ বড় বড় বাজারে পাইকারি চিনি ব্যবসায়ীদের চাহিদা মতো মিল হতে সরাসরি চিনি সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর বাজার নিয়ন্ত্রণে ২২-২৩ অক্টোবর ঢাকা মহানগরসহ দেশব্যাপী ১০৩টি তদারকি অভিযান পরিচালনা করে। একইসঙ্গে দেশব্যাপী অভিযান ও তদারকিকালে চিনির দাম বেশি রাখা এবং মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করাসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ ও আদায় করা হয়।
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক জানান, চিনির দাম বাড়ার পরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় অধিদফতরের পক্ষ থেকে সারাদেশের বাজারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। পাঁচটি বড় বড় রিফাইনারিতে আমরা অভিযান চালিয়েছি। যেসব জায়গায় আমরা অনিয়ম পাচ্ছি, তাদেরকে আইন অনুযায়ী, শাস্তিসহ জরিমানা করছি।
তিনি বলেন, ‘বাজার স্থিতিশীল করতে মিল মালিক, রিফাইনারি, পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছি। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা পেলাম। এটা শুধু আমাদের একার নয়, বৈশ্বিক সমস্যা’।