গোনাহমুক্ত জীবনের নমুনা ‘খাজা কুতুবউদ্দীন ও সুলতান আল-তামাশ’

380

 

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তা‘আলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর।
কুতুবুল আকতাব হযরত খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:) (জন্ম ১১৭৩-মৃত্যু ১২৩৫) ছিলেন একজন মুসলিম সুফি সাধক। তিনি দক্ষিণ কিরগিস্তানের উশ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ১৬তম শতাব্দিতে মোগল সম্রাট আকবরের উজির আবুল ফজল ইবনে মোবারক রচিত কুতুবউদ্দিন (রা:) এঁর জীবনী‘‘আইন-ই-আকবর”-এ উল্লেখ করা হয়, তাঁর পিতার নাম কামালুদ্দিন। তিনি খাজা কুতুবউদ্দিন (রা:) এঁর দেড় বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
খাজা কুতুবউদ্দিন (রা:) আসল নাম বখতিয়ার এবং পরে কুতুবউদ্দিন নামটা দেয়া হয়। তিনি হোসাইন ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়লা আনহু’র মাধ্যম হয়ে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বংশের সাথে মিলিত হয়েছেন। তার মা যিনি নিজেই একজন শিক্ষিত মহিলা ছিলেন,তাঁর শিক্ষার জন্য শাইখ আবু হিফসকে নিয়োগ দেন।
হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রা:) তার ভ্রমণের সময় যখন আউশ দিয়ে যাচ্ছিলেন,খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার (রা:) তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন এবং তাঁর থেকে খেলাফতও গ্রহণ করেন। এভাবেই তিনি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রা:) প্রথম খলিফা হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি চিশতিয়া ত্বরিকার সাধক ছিলেন। তার নামেই দিল্লীর বিখ্যাত কুতুব মিনার উৎসর্গ করা হয়। শিষ্যত্ব গ্রহণ করার আগেই চিশতিয়া ত্বরিকা শুধুমাত্র আজমীর এবং নাগাউর এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দিল্লীতে স্থায়ীভাবে এই ত্বরিকাকে প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দরগাহ্ (সমাধি) মেহরাউলের জাফর মহলের পাশেই অবস্থিত এবং পুরানো দরগাহ্ দিল্লিতে অবস্থিত, যেখানে তাঁর ওরশ পালিত হয়।
ভারতের দিল্লিতে যার নামে ‘কুতুব মিনার’ দাঁড়িয়ে আছে তিনি হলেন খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রা:)। গোনাহ মুক্ত জীবনের একটি নমুনা ফুটে ওঠেছে তাঁর জীবনীতে। ‘ওলামায়ে হিন্দকা শানদার মাজি’ কিতাবে একটি ওয়াকেয়া লিখিত হয়েছে। ওয়াকেয়াটি হলো-
আল্লামা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রা:) মৃত্যুর আগে তার সন্তান ও খলিফাদের ওসিয়ত করলেন যে, আমার মৃত্যুর পর যাকে-তাকে দিয়ে আমার জানাজা পড়াবে না। আমার জানাজা যে ব্যক্তি পড়াবে; তার মধ্যে ৪টি গুণ থাকতে হবে। যদি এ ৪টি গুণ কোনো ব্যক্তির জীবনে পাওয়া না যায়; তবে বিনা জানাজায় আমার লাশ দাফন করবে।
খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শর্তগুলো হলো-
* যে ব্যক্তি জীবনে কোনো দিন তাকবিরে উলা ব্যতিত নামাজ পড়েনি; এমন ব্যক্তি।
* যার জীবনে একদিনও তাহাজ্জুদ কাজা হয়নি; এমন ব্যক্তি।
* যে ব্যক্তি তার চোখের দ্বারা পরনারী দেখে কখনো গোনাহের কল্পনা করেনি; এবং
* যে ব্যক্তি জীবনে কোনো দিন আছরের সুন্নাতও কাজা করেনি।
খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার (রা:) কাকী ইন্তেকাল করলেন। ইন্তেকালের পর তাঁকে জানাজার জন্য প্রস্তুত করে মাঠে নেয়া হলো। সেখানে উল্লেখিত ৪টি শর্ত উল্লেখ করে ঘোষণা করা হলো- যিনি বা যারা এ গুণগুলোর অধিকারী তিনি খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর (রা:) জানাজা পড়ানোর জন্য সামনে আসুন।
মাঠ ভর্তি মানুষ। কোনো সাড়া শব্দ নেই। এতো অনেক বড় গুণের কথা। এ গুণ অর্জন করা সহজ ব্যাপার নয়। সারা মাঠের লোকগুলো মাথা নিচু করে অশ্রæ বিসর্জন দিতে লাগলো। নিজেদেরকে অপরাধী মনে করে নিরবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
মাঠ থেকে কোনো প্রতি উত্তর না আসায় খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী’র (রা:) ছেলে, খলিফা, ছাত্রসহ শুভাকাঙ্ক্ষীরা বিনা জানাজা তাকে দাফনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সন্তান ও খলিফারা লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিনা জানাজায় দাফন করার জন্য রওয়ানা হবেন। এমন সময়-
সামনের কাতার থেকে একজন লোক কদম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘থামো !’ কফিনে হাত লাগিয়ে বললেন,‘আমি জানাজা পড়াব।
এ ব্যক্তি আলেম নয়, তবে সাধারণ মানুষও নয়; তিনি হলেন দিল্লির সুলতান শামসুদ্দিন আল-তামাশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
দিল্লির সুলতান শামসুদ্দিন আল-তামাশ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, কফিনের সামনে গিয়ে কাফন সরিয়ে খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীর (রা:) কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘ওগো আল্লাহর ওলি ! সারা জীবন নিজে আমল করে করে; তোমার আমল গোপন করে তুমি চলে গেলে; আর আজকের এ ময়দানে আমার আমলগুলোকে প্রকাশ করে দিলে।’ আমি ভয় করি; আমার আমলগুলো প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় না জানি আমি ধ্বংস হয়ে যাই।’ এ হলো গোনাহমুক্ত জীবনের নমুনা। একজন বাদশাহ যদি নিজের সকল ব্যস্ততা সত্ত্বেও এমন আবেদের জীবনযাপন করতে পারেন তাহলে আমরা যারা বিভিন্ন চাকরি বা ব্যবসা কিংবা অন্য পেশায় নিয়োজিত আমরা কি পারিনা এভাবে নিজেকে ইবাদতে ব্যস্ত রাখতে। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে উল্লেখিত গুণগুলো অর্জন, গোনাহমুক্ত জীবন গঠন ও কুরআন-হাদিস মোতাবেক জীবন সাজানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস
এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড