গেটম্যান গেটে নেই চালকের সময় নেই

17

নিজস্ব প্রতিবেদক

যাত্রা পথে গাড়ি নিয়ে ছুটছে মানুষ। সবার অদ্ভুত এক তাড়া। রেললাইনের লেভেল ক্রসিংয়ে সিগন্যাল পড়লে বাড়ে তাড়াহুড়ো। যেন ‘মরণ রেসে’ ঝাঁপিয়ে পড়ছে গাড়ির চালক-পথচারী। ভাগ্যক্রমে অনেকে বেঁচে গেলেও প্রায়শ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খবরে অন্ধকার নেমে আসে পরিবারগুলোর আকাশজুড়ে। দায় কার? তা জানতে তদন্ত কমিটির মত কাগুজে প্রক্রিয়ায় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ যেমন জাগছে না, তেমনি চালক-যাত্রীদেরও সচেতনতা বাড়ছে না। জীবন সুরক্ষায় কারোরই সময় নেই। দুর্ঘটনার খবর দুয়েকদিন যেতেই চাপা পড়লেও আক্রান্ত পরিবারগুলো আজীবন এর বোঝা বয়ে বেড়ায়। তাই সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠছে, আগে যাওয়ার এই ‘মরণ রেস’ থামাবে কে?
গতকাল শনিবার খুলশী এলাকার জাকির হোসেন রেলক্রসিংয়ে ( গেট নং-টি-৩ স্পেশাল) ডেমু ট্রেনের সঙ্গে বাস ও সিএনজি অটোরিকশার ত্রিমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন তিনজন। আহত হয়েছেন আরও দশজন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আহতদের মধ্যে সাতজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ওই রেললাইন ক্রসিংয়ে গেটম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. আলমগীর। নিয়মমাফিক রেল আসার আগে ব্যারিয়ার ফেলে গাড়ি আটকানোর কথা থাকলেও ওই সময় উপস্থিতই ছিলেন না তিনি। ব্যস্ততম এ গেটে প্রায় সময় ব্যারিয়ার গেট না ফেলে হাতের ইশারায় ট্রেন আসার সংকেত দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলওয়ে ট্রাফিক বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকা এ গেটে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের কথা তিন জন গেটম্যানের। আলমগীর ভুইয়া ছাড়াও এ গেটে ডিউটিতে থাকেন গেটম্যান মাকসুদ এবং আজাদ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, সকাল ১০টার দিকে রেললাইনের পাশে একটি বাস আসলে ট্রাফিক পুলিশ মনির (৪৫) সংকেত দিয়েছিলেন। ওই সময় নাজিরহাট থেকে ডেমু ট্রেনটি বটতলীর দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু বাসটি ট্রাফিক পুলিশের সংকেত মানেনি। এ সময় ট্রেনটি বাসের সামনের অংশে সজোরে আঘাত করে। এতে পাশে থাকা একটি সিএনজি অটোরিকশাকে বাসটি পেছন দিক দিয়ে ধাক্কা দেয়। এসময় ট্রাফিক পুলিশ মনির ও সিএনজি অটোরিকশার চালক ঘটনাস্থলেই মারা যান।
রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী জানান, এ ঘটনায় রেলওয়ের জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গেটম্যানের কোনো অবহেলা থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করব।
শুধু এ একটি দুর্ঘটনা নয়, গত ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের ফৌজদার হাটের বাংলাবাজার এলাকায় স্ক্র্যাপবাহী (লোহা) ভারী ট্রাক রেললাইনে তুলে দেওয়ায় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় যাত্রীবাহী ট্রেন মেঘনা এক্সপ্রেস। চালকের দক্ষতায় সেদিন রেলক্রসিংয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পান মেঘনা এক্সপ্রেসের শত শত যাত্রী। চলতি বছরের ৫ সেপ্টেম্বর নগরের কদমতলী এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় আহত হন সিএনজি চালিত অটোরিকশার তিন যাত্রী। ওইদিন আনুমানিক রাত ১১টার দিকে কদমতলীর সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, দোহাজারী রুটে চলাচল করা পিডিবির শাটল ট্রেন চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে পাহাড়তলীর লোকোশেডে যাচ্ছিল। এ সময় দু’পাশের লেভেল ক্রসিংয়ের ব্যারিয়ার (প্রতিবন্ধক) ফেলে দিয়েছিল লাইনম্যান। কিন্তু লেভেল ক্রসিংয়ের উল্টো পথে এসে রেললাইনে উঠে পড়ে ওই সিএনজি। এতে দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়। দুর্ঘটনার পর সিএনজি চালক পালিয়েছিল। পরে রেলওয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। তাছাড়া গত বৃহস্পতিবার রাতে আখাউড়া থেকে ঢাকা ফেরার পথে সরারচর স্টেশন এলাকায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রলি। এতে আহত হন বিভাগীয় রেলওয়ে কর্মকর্তা সাদেকুর রহমানসহ কয়েকজন রেল কর্মকর্তা। ঢাকা রেলওয়ে কন্ট্রোল অফিস থেকে জানানো হয়েছে- ব্যারিয়ার গেটের নীচে দিয়ে মোটরসাইকেল ঢুকে পড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ রেল বিভাগের তথ্য মতে- স্পেশাল, এ, বি ও সি চার ক্যাটাগরির লেভেল ক্রসিং রয়েছে। সাধারণ রেল জাংশন, বিভাগীয় শহর ও বড় শহরের ভেতরের লেভেল ক্রসিংগুলো স্পেশাল এবং ‘এ’ ক্যাটাগরির। স্পেশাল ক্যাটাগরির লেভেল ক্রসিংগুলোতে ২৪ ঘণ্টাই তিনজন গেটম্যান পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। ‘এ’ ক্যাটাগরির লেভেল ক্রসিংয়ে থাকেন ২ জন করে গেটম্যান। ‘বি’ ক্যাটাগরির লেভেল ক্রসিংয়ে কোথাও গেটম্যান আছেন আবার কোথাও নেই। কোনো গেটে শিকল আছে আবার কোনোটাতে তাও নেই। ‘সি’ ক্যাটাগরির লেভেল ক্রসিং কার্যত পুরোটাই অরক্ষিত। এতে শিকল, লিভার বা গেটম্যান কিছুই নেই। রেলের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রেলের পূর্বাঞ্চলে লেভেল ক্রসিং রয়েছে ১ হাজার ২৩০টি। এরমধ্যে ৫১১টি বৈধ হলেও অবৈধ প্রায় দেড়গুণ। এরমধ্যে চট্টগ্রাম রেলওয়ে এলাকায় ২০৫টি ক্রসিংয়ের মধ্যে ১১০টি বৈধ হলেও অবৈধ ক্রসিং রয়েছে ৯৫টি। বর্তমানে গেট ব্যারিয়ার আছে মাত্র ২৫৭টি ক্রসিংয়ে। আর ব্যারিয়ার ছাড়া ক্রসিং রয়েছে ৯৩৩টি। এছাড়া ২২৯টি গেটে গেটম্যান থাকলেও গেটম্যান ছাড়া ক্রসিং রয়েছে ৯৩১টি। হাটহাজারী থেকে নাজিরহাট পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার রেলপথে ১৫ থেকে ২০টি বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২টিতে জনবল রয়েছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে বিগত ৪ বছরে দ্রুত ক্রসিং পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুবরণ করেন ১ হাজার ৬৯ জন। এরমধ্যে গত বছরেই মারা যান ৩৩৭ জন। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে গেটম্যান ও লিভার না থাকার করণে।