গুণী লেখক-গবেষক শিমুল বড়ুয়া ও তাঁর বই

28

 

শিমুল বড়ুয়া, একজন লেখক-গবেষক-শিক্ষাবিদ হিসেবে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। গবেষণামূলক গ্রন্থের জন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁর মেধা ও শ্রমলব্ধ দুটো গবেষণাগ গ্রন্থের জন্য আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার-২০১২ ও মহাকবি মাইকেল মধুসূদন পদক-২০১৮ পেয়েছেন শিমুল বড়ুয়া। দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা-রাজনীতির কীর্তিমান কয়েকজন ব্যক্তিত্বের স্মারক ও সম্মাননাগ্রন্থ সম্পাদনা করে জাতীয় কর্তব্য সাধন করেছেন তিনি। কারণ, যাঁদের স্মারক ও সম্মাননাগ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেছেন তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে শ্রদ্ধা-সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাঁদের অসামান্য কৃতিত্বের জন্য। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে একটির কথা উল্লেখ করছি- ‘অনোমা: ছড়াসাহিত্যিক সুকুমার বড়ুয়া সম্মাননাগ্রন্থ’। যেটি দেশের জীবন্ত কিংবদন্তীতুল্য ছড়াকার ছড়ার-যাদুকর সুকুমার বড়ুয়াকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। সাধারণত আমাদের দেশে কীর্তিমান মনীষীরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেই স্মারকগ্রন্থ করতে দেখি আমরা। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের অনোমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ব্যতিক্রম কাজ করে নজির স্থাপন করেছে জীবিতকালে ছড়ারাজ ‘সুকুমার বড়ুয়া সম্মাননাগ্রন্থ’ প্রকাশ করে। সম্মাননাগ্রন্থটিতে সুকুমার বড়ুয়াকে নিয়ে লিখেছেন দুই বাংলার খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক ও সুকুমার বড়ুয়ার উত্তরসূরি ছড়াকাররা। গ্রন্থটি ২০১১ সালে প্রকাশিত হলেও আমার পাঠ-টেবিলে এসেছে ঠিক দশ বছর পর ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি, যে-দিন সুকুমার বড়ুয়ার তিরাশি তম জন্মদিন। এটি একটি অসাধারণ সুসম্পাদিত গ্রন্থ। গ্রন্থটি পাঠ করে বাংলা ছড়ার জগতে সুকুমার বড়ুয়ার সিন্ধু পরিমাণ অবদান অনুধাবন করতে পারবেন যে কোনো পাঠক, আগামী প্রজন্মও। এই অসামান্য গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন গবেষক শিমুল বড়ুয়া। যে-কাজ করার কথা সুকুমার বড়ুয়ার উত্তরসূরি ছড়াকারদের। করেছেন অনোমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী বা শিমুল বড়ুয়া। বাংলাদেশের তথা দুই বাংলার ছড়াকারদের পক্ষ থেকে শিমুল বড়ুয়া ও অনোমাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এ লেখার মধ্য দিয়ে। গ্রন্থটির পৃষ্ঠপোষক লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়াকেও ধন্যবাদ না-দিলে হয় না।
সুকুমার বড়ুয়া সম্মাননাগ্রন্থ ছাড়াও আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই সম্পাদনা করেছেন শিমুল বড়ুয়া, সেটা আগেই উল্লেখ করেছি। লেখক-গবেষক-শিক্ষাবিদ শিমুল বড়ুয়া প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবেও সুনামের সাথে সীতাকুÐ লতিফা সিদ্দিকী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাহিত্যের নানা আড্ডায় শিমুল বড়ুয়ার জ্ঞানগর্ভ মুক্ত-আলোচনা শুনেছি। মিষ্টি-কোমল-নম্র ভাষায় কথা বলেন তিনি। এর ভেতরেও তাঁর মধ্যে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য যে কঠোরতা দরকার তার একটা ভাব লক্ষ্য করা যায়। যেটা প্রতিষ্ঠানের বাইরে তিনি সম্পূর্ণ আড়ালে রাখতে চান।
ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির পাঠগ্রহণ করা শিমুল বড়ুয়া মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক থাকার ব্রত নিয়ে যাপন করেন তাঁর লেখক-জীবন। এ-সবের বাইরে শিমুল বড়ুয়ার যে গুণ আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে সেটা হলো- শিমুল বড়ুয়া একজন সুবক্তা। ডিসেম্বর ২০২০ সাল চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম অনলাইন বাংলা বইমেলার সার্ভার স্টেশন চট্টগ্রাম একাডেমিতে মেলার সতেরো তম দিনে সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল ‘চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ’। এতে প্রধান আলোচক ছিলেন রবীন্দ্র গবেষক শিমুল বড়ুয়া। অনুষ্ঠানের শুরুতে বইমেলার সংগঠক শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ আলোচক শিমুল বড়ুয়াকে বলে দিলেন আধাঘন্টা বক্তব্য দিবেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের যে কোনো দিক নিয়ে বলতে গেলেই যেখানে টানা কয়েক ঘণ্টা বললেও শেষ হবার নয়, সেখানে আধাঘন্টায় কতটুকু বলা যাবে আর? রাশেদ ভাইয়ের কথার বিপরীতে একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না তিনি। শুধু মনে ধারণ করলেন কবি রাশেদ রউফের সময়ের সীমাবদ্ধতা নিয়ে পরামর্শ। পরে তিনি মঞ্চে যখন বক্তব্য শুরু করলেন, বক্তব্য দিচ্ছেন, কথা বলছেন সাবলীল-অনর্গল, যেন কোনো বক্তা সরাসরি বক্তব্য দিচ্ছেন না, রেকর্ড করা বক্তব্য শোনানো হচ্ছে। ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও জীবনে চট্টগ্রাম’ নামে তাঁর একটি গবেষণাগ্রন্থ আছে। যে গ্রন্থের জন্য তিনি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন পদক পেয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য শুনতে-শুনতে তখন ভাবছিলাম নিজের লেখা গ্রন্থখানা কি তাঁর মুখস্ত? অনেকটা সেভাবেই তিনি চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অনর্গল বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। সময়ের সীমাবদ্ধতা নিয়ে রাশেদ ভাইয়ের পরামর্শের কারণে তিনি খুব দ্রæত বলছিলেন; কিন্তু তাঁর বক্তব্য শ্রোতারা শুনতে-বুঝতে সামান্যটুকু বিঘœতা ঘটছিল না। জড়তাহীন খুবই গোছালো ও স্পষ্ট ভাষায় বলছিলেন। স্বরের উঠানামা যেখানে যেমন দেওয়ার কথা সেভাবেই। হল ভর্তি দর্শকশ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন তাঁর সারগর্ভ বক্তব্য। রাশেদ ভাইও সময় নিয়ে ভাবছিলেন না আর তখন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও জীবনে চট্টগ্রাম বিষয়ে বিশদ আলোচনা করলেন তিনি একটানা। বইমেলার ৩১ দিনের মধ্যে দশের অধিক সেমিনারে আমি উপস্থিত ছিলাম। প্রত্যেকটা সেমিনারে নির্ধারিত বিষয়ে যথার্থ আলোচনা করে উপস্থিতি ও অনলাইন দর্শকশ্রোতার প্রশংসা কুড়িয়েছেন বিজ্ঞ আলোচকেরা। আমার অনুভবে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন ‘চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ’ বিষয়ে বক্তব্য রেখে শিমুল বড়ুয়া।
তাঁর গবেষণামূলক বই ‘রবীন্দ্র সাহিত্য ও জীবনে চট্টগ্রাম’ পাঠ করে আমরা চট্টগ্রামবাসী গর্বিত হতে পারি- কবিগুরুর সাথে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের গুণী মানুষদের দারুণ সংযোগ ছিলো জেনে। রবীন্দ্রনাথ চট্টগ্রামে এসেছিলেন, দুই দিন থেকেছেন, চট্টগ্রাম শহরে ঘুরেছেন, চট্টগ্রামে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম। এই বইয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে চট্টগ্রামের যেসব গুণী মনীষীদের সম্পর্ক ছিল তাঁদের সম্পর্কে কয়েক পৃষ্ঠা করে লেখা হয়েছে। এর মাধ্যমে উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের প্রথম দিকের চট্টগ্রামের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক,অনুবাদক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, খ্যাতিমান আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, নাট্য নির্দেশক, সাংবাদিকসহ চট্টগ্রামের অগ্রসর মনিষীর পরিচয় পাই আমরা। কবিগুরুর সাথে নানাভাবে সংযোগ ছিল এমন কীর্তিমান ব্যক্তিত্বরা হলেন কবি নবীনচন্দ্র সেন, নবীনচন্দ্র দাস, লেখিকা সৌদামিনী খাস্তগীর, পন্ডিত ধর্মরাজ বড়ুয়া, শিক্ষাবিদ কুদুমিনী খাস্তগীর, অনুবাদক রজনীরঞ্জন সেন, সাহিত্য সমালোচক শশাঙ্কমোহন সেন, নাট্য নির্দেশক কেদারনাথ দাশগুপ্ত, কবি মোহিনীরঞ্জন সেন, বিনীতা রায়, আবুল ফজল, কাজী কবির উদ্দিন আহমদ, অরবিন্দ বড়ুয়া, শামসুন নাহার মাহমুদ, রাহাত আরা বেগম, লোকমান খান শেরওয়ানী, বিপ্লবী অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত, আহসান আহমদ আশক, মোহাম্মদ ফেরদাউস খান, ফিরদৌস আরা বেগম, মামুন মাহমুদ, যামিনীকান্ত সেনসহ আরো বেশ কয়েক গুণীজন। এঁদের মধ্যে সাধারণত আমরা কবি নবীনচন্দ্র সেন, অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত, সাহিত্যিক আবুল ফজলসহ মাত্র কয়েকজনের কীর্তি সম্পর্কে জানি। কেউ-কেউ হয়ত বইয়ে উল্লিখিত মনিষীদের অনেকের সম্পর্কে জানেন। কিন্তু উল্লিখিত সবাইকে জানেন না।
তখনকার বয়োজ্যেষ্ঠ কবি নবীনচন্দ্র সেনের সাথে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ও অন্য সবার সাথে সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির নানাবিধ বিষয়ে চিঠি আদানপ্রদানের মাধ্যমে যোগাযোগ, কাব্য-মতবিনিময় সম্পর্কে জানতে পারি বইটি পাঠে। সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও সাহিত্যে চট্টগ্রামের সংযোগ সম্পর্কে জানতে সক্ষম হই। বইটি পাঠে যে বিষয়টি জেনে আবেগের ছোঁয়া লেগেছে প্রাণে তা হলো, ১৯০৭ সালের ১৭ জুন কবি চট্টগ্রামে আসার পরদিন ১৮ জুন সকালে চট্টগ্রাম শহর ঘুরে কর্ণফুলী নদী দেখতে নদীর তীরে জাহাজঘাটা গিয়েছিলেন। কবি জাহাজঘাটায় কয়েকজন খালাসীর সাথে আলাপে তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘তোমার চট্টগ্রাম কেমন দেশ?’ তদুত্তরে খালাসী বলেছিলেন, ‘বাবু এরূপ স্থান জগতে আর নাই; মক্কা-মদিনার পরই আমরা চট্টগ্রামকে গণ্য করি।’ কী দারুণ আবেগী কথা! এতে চট্টগ্রামের মানুষের জন্মভূমিপ্রেম স্বদেশপ্রেম দেখে কবিগুরু যেমন অভিভূত হয়েছিলেন; এর একশ তেরো বছর পর এসে আমরা গর্ববোধ করতে পারি এই অনুবাধন করে- চট্টগ্রামের মানুষের হৃদয়ে প্রবল স্বদেশপ্রেম বহু পুরানো।
গবেষক শিমুল বড়ুয়ার একটি বইয়ের কথা বলবো বলে দুটো বইয়ের কথা যখন বললাম, তাহলে ‘চট্টগ্রামের প্রবাদ-প্রবচন’ বইটির কথাও একটু বলি। খড়িমাটি থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালে। আমরা শৈশব থেকে মা-চাচী-দাদী-নানী কিংবা দাদা-নানাদের মুখে চট্টগ্রামের ভাষায় নানা প্রবাদ-প্রবচন শুনে আসছি। এখনো শুনি, তবে আগের মতো নয়, একটু কম চর্চা হয় এখন। প্রবাদ-প্রবচনগুলোতে অল্প কথায় বড় অর্থ থাকে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ইংগিত থাকে। অথচ প্রবাদ-প্রবচনগুলোকে নতুন প্রজন্ম হালকা কথা ভেবে উড়িয়ে দেয়। এই প্রজন্মের অনেকেই এগুলোর অর্থ বোঝতে চেষ্টা করেন না। চর্চা কমে আসায় অনেক প্রবাদ-প্রবচন হারিয়ে যেতে বসেছে। শিমুল বড়ুয়া চট্টগ্রামের প্রবাদ-প্রবচনগুলো এই বইয়ে সযত্নে লিপিবদ্ধ করেছেন শব্দার্থ ও প্রমিত বাংলাসহ। দারুণ একটা কাজ। বইটি ১৮৪ পৃষ্ঠার। এতে বোঝা যায় এখানে চট্টগ্রামের বিপুল প্রবাদ-প্রবচন সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রবাদ-প্রবচনগুলোর মর্মকথাসহ বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ভাষা তথা বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য এই বইটির বহুল প্রচার-প্রসার হওয়া দরকার। নতুন প্রজন্ম থেকে আগামী প্রজন্মের হাতেও এই বই যেনো পৌঁছে সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাহলেই চট্টগ্রামের ভাষার ঐতিহ্য এই প্রবাদ-প্রবচনগুলোর চর্চা বৃদ্ধি পাবে। এর মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জানতে পারবে চট্টগ্রামের ভাষা কতো সমৃদ্ধ ভাষা।
গুণী লেখক-গবেষক শিমুল বড়ুয়া বাবা ভূপতি রঞ্জন বড়ুয়ার মুখে হাসি ফুটিয়ে, মা নীহারকতা বড়ুয়ার কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৬ সালের ১৮ জানুয়ারি। সেই হিসেবে জানুয়ারি মাস তাঁর জন্মমাস। তাঁকে জানাই জন্মমাসের শুভেচ্ছা। সামনের দিনগুলোতে তিনি আরো গবেষণামূলক বই নিয়ে তাঁর গুণমুগ্ধ অগ্রসর পাঠকের সামনে হাজির হবেন; পুনঃপুন প্রশংসিত হবেন- এই প্রত্যাশা রইলো।