গুজব ছড়িয়ে খুচরায় দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা

13

মনিরুল ইসলাম মুন্না

চট্টগ্রামে রমজান ঘিরে ভোগ্যপণ্যের বাজারগুলো বেশ জমজমাট থাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে গত কয়েকদিনে পাইকারিতে দাম না বাড়লেও খুচরা বাজারে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতি কেজি অস্ট্রেলিয়ান ছোলা বিক্রি হচ্ছে পাইকারিতে ৯৩ টাকা আর খুচরায় ১১০ টাকা, মোটা মশুর ডাল পাইকারিতে ৯৯ টাকা আর খুচরায় ১১০ টাকা, চিকন মশুর ডাল পাইকারিতে ১২৮ টাকা আর খুচরায় ১৪০ টাকা, খেসারি ডাল পাইকারিতে ১১০ টাকা আর খুচরায় ১২০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ পাইকারিতে ৯৮ টাকা আর খুচরায় ১১০ টাকা, ভারতের পেঁয়াজ পাইকারিতে ১২০ টাকা আর খুচরায় ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, চায়না রসুন পাইকারিতে ১৭০ টাকা আর খুচরায় ১৯০ টাকা, আদা পাইকারিতে ১৭০ টাকা আর খুচরায় ১৮০ টাকা, জিরা পাইকারিতে ৭১০ টাকা আর খুচরায় ৭৫০ টাকা, কিসমিস পাইকারিতে ৫০০ টাকা আর খুচরায় ৫৫০ টাকা, এলাচি পাইকারিতে ২৩৬০ টাকা আর খুচরায় ২৮০০ টাকা, দারচিনি পাইকারিতে ৩৮৫ টাকা আর খুচরায় ৪৭০ টাকা, জাহেদি খেজুর (১০ কেজির প্যাকেট) পাইকারিতে ২৫৮০ টাকা আর খুচরায় ৩২০০ টাকা, আজওয়া খেজুর (৫ কেজির প্যাকেট) পাইকারিতে ১৯০০ টাকা আর খুচরায় ২৫০০ টাকা।
তাছাড়া খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ চিনি বিক্রি হচ্ছে সিটি গ্রুপ ৪৯৪২ টাকা, মেঘনা গ্রুপ ৪৯২৫ টাকা এবং এস আলম ৪৯১০ টাকা। তবে গুদামে আগুন লাগায় গত তিনদিন ধরে এস আলমের চিনি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। আগামী শনিবার থেকে তারা সরবরাহ চালু করবে বলে জানা গেছে। এতে অন্যান্য কোম্পানির চিনির দামও কমে আসবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে পাইকারি বাজারে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৪৭ টাকা ৩৭ পয়সা দরে আর খুচরা বাজারে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত সয়াবিন ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ লিটারের ফ্রেশ সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মতে, গুদামে আগুন লাগায় গত তিনদিন ধরে এস আলমের চিনি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে ঢাকার ব্যবসায়ীরা চিনি মণপ্রতি ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। আর এ সুযোগটাকে কাজে লাগাচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা প্রতিকেজি চিনি ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে বিক্রি করছেন।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘খাতুনগঞ্জে গত ১৫ দিনে রমজানের কোনো পণ্যের দাম বাড়েনি বা কমেনি। দুই সপ্তাহ আগে যা ছিল, বর্তমানেও তা রয়েছে। তবে কিছু খুচরা ব্যবসায়ী ও অসাধু সিন্ডিকেট অতি মুনাফার আশায় তেল-চিনির দাম ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রশাসন যদি ঠিকমত তদারকি করে, তবে সিন্ডিকেট মাথাচাড়া দিতে পারবে না।’
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে এবার পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। তারপরও রমজানে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ চেইন সচল রাখতে সরকারি নানা উদ্যোগে আমদানিকারকরা পর্যাপ্ত এলসি (ঋণপত্র) খোলেন। বিশেষত, ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে এবার আগেভাগে পদক্ষেপ নেয় সরকার। রমজানে বেশি চাহিদা থাকা পণ্যগুলো ৯০ দিনের সাপ্লাইয়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে পুরোনো আমদানিকারকরা এখন বাকিতেও পণ্য আমদানি করার সুযোগ পেয়েছেন। তবে এলসি খোলার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ন্যূনতম পেমেন্ট দিয়েও রমজানের ভোগ্যপণ্য আমদানি করেন আমদানিকারকরা। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমদানিকারকরা বিশেষ এ সুবিধা পাবেন।
রমজান সামনে রেখে গত ৮ ফেব্রুয়ারি চাল, তেল, চিনি ও খেজুরের শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ নিয়ে পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে সংস্থাটি। এনবিআর ঘোষিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এসব চাল আমদানিতে রেগুলেটরি ডিউটি (নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক) ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৫ মে পর্যন্ত চাল আমদানিকারকরা এ সুবিধা পাবেন।
অন্যদিকে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে, যা আগে ছিল টনপ্রতি দেড় হাজার টাকা। আর পরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে, যা আগে তিন হাজার টাকা ছিল। শুল্ক ছাড়ের এ সুবিধা আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বহাল থাকবে। এছাড়া পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে দেশে পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো ভ্যাট দিতে হবে না। এছাড়া বিদেশ থেকে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এবং পাম অয়েল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ের ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তার মানে সয়াবিন ও পাম অয়েলের আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট কমানো হয়েছে। একইভাবে খেজুর আমদানিতে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত আমদানিকারকরা এ সুবিধা পাবেন।
খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী ও পিএন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারি এমদাদুল হক রায়হান পূর্বদেশকে বলেন, ভোজ্যতেলের বাজারে খাতুনগঞ্জে পাম অয়েল বেশি কেনাবেচা হয়। আজ (বৃহস্পতিবার) এস আলম গ্রুপের পাম অয়েল ৪৭৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তা গত সপ্তাহে ছিল তা ৪৭৮০-৪৭৮৫ টাকা। এছাড়া বৃহস্পতিবার সিটি গ্রুপের পাম অয়েল ৪৮২০ টাকা এবং মেঘনা গ্রুপের পাম অয়েল ৪৮৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে পাম বা সয়াবিন তেল সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। বর্তমানে যে দাম রয়েছে, তা আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এ বছর রমজানে ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি ও মজুত রয়েছে বলে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যদি তা-ই হয় তবে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ার কথা নয়। দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারিভাবে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। সেটা হলে ভোক্তারা সুফল পাবেন। তা নাহলে একটা সিন্ডিকেট বরাবরের মত মাথাচাড়া দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে।