গুচ্ছ পরীক্ষার ‘প্রশ্ন’ নিয়ে সতর্কতা

21

 

ফেসবুকে ঘুরছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির গুচ্ছ পরীক্ষার ‘প্রশ্নসহ উত্তরপত্র’ ও ‘সাজেশন’ বিক্রির পোস্ট, লোভে পড়ে টাকা দিয়ে ধরাও খাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ; আর এ বিষয়ে সতর্ক করে কর্তৃপক্ষ বলছে- ‘প্রশ্ন ফাঁসের সুযোগই নেই’। একের পর এক ফেসবুক গ্রুপে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন দেওয়ার প্রচারণার ফাঁদে পড়ে টাকা খোয়ানোদের একজন তাইজুল হাসান। তিনি বলেন, ‘সাজেশনের জন্য আমি আর আরেকজন মিলে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। একজনকে ওরা ব্লক করে দিয়েছে শুনে আমি কথা বলতে গেছিলাম, তারপর আমাকেও ব্লক করে দিয়েছে। সাজেশনও পেলাম না, টাকাও গেল। পরীক্ষা কমিটির প্রতি আমাদের অনুরোধ, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। আমাদের অনেকেই এভাবে প্রতারিত হচ্ছে’।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রশ্ন ফাঁসের সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমদ নূর। তিনি বলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাস অনুসারে পরীক্ষা হবে। বাইরে থেকে কিছু আসার সুযোগ নেই। আমাদের কাছে কেউ কমপ্লেইন করলে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাব’।
প্রথমবারের মতো গুচ্ছভুক্তভাবে ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। আগামি ১৭ অক্টোবর শিক্ষার্থীদের শারীরিক উপস্থিতিতে হবে এ পরীক্ষা। মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান- তিনটি গুচ্ছে ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে এমসিকিউ পদ্ধতিতে। সেই ফলাফলের ভিত্তিতে মেধাতালিকা প্রকাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব শর্ত অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি করবে। সূচি অনুযায়ী ১৭ অক্টোবর হবে বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষা।
পরীক্ষা শুরুর ঠিক আগে ফেসবুকের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রুপে শিক্ষার্থীদের শতভাগ নিশ্চয়তার প্রলোভন দেখিয়ে সাজেশন এবং প্রশ্নপত্র দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে।
বেশ কয়েকটি পোস্টে পরীক্ষার আগের রাতে ‘সাজেশন’ পেতে শিক্ষার্থীদের ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে অপরাধ দমন করতে, অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘ছেলে-মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটা জীবন-মরণ ব্যাপার। তারা নিজেরা প্রস্তুতি নেওয়ার পরও সুযোগ সুবিধার চেষ্টা করে। যারা প্রশ্ন দেওয়া, ভর্তি করিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেবে বলে; শেষ পর্যন্ত তারা তা করতে পারে না। আর করলেও এমন একটা পন্থায় যায়, এই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎই নষ্ট হয়ে যায়’।
তার মতে, শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সততা ও নীতিশিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এ বিষয়ে সবাইকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদেরও আমরা সেই শিক্ষা দিতে পারিনি। তারাও কিন্তু ভর্তির মৌসুমে টাকা পয়সা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে’।
বিভ্রান্তির ফাঁদ এড়াতে সোশাল মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত পোস্ট নিয়ন্ত্রণ করা উচিত জানিয়ে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘সাথে সাথে সেগুলো সরিয়ে ফেলে- যে এটার উৎস তাকে দ্রুত চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গণমাধ্যমে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কে কী লিখেছে, সেটার ব্যাপারে যেমন অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে; তার চেয়েও আরও বেশি শক্তভাবে নেওয়া উচিত নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের যারা ফাঁদে ফেলছে তাদের ব্যাপারে’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, ‘কয়েকটা টাকার জন্য লোকগুলো অনেক বড় ক্ষতি করছে। আমাদের গভীরভাবে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করার দরকার আছে’।
প্রলোভনের ফাঁদ, শিক্ষার্থীদের কৌতুহল ও ‘বøক’
২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী ছানোয়ার হোসেন শান্ত বলেন, ‘আমার এক বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে, তাকে ইনবক্সে নক করে একজন বলছে; ‘আমি ইউজিসি থেকে থেকে জলিল স্যার বলছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফাউল, গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিট নিতে চাইলে যোগাযোগ করো; দুই লাখ টাকা লাগবে’। পরে সে আর যোগাযোগ করেনি’।
officer education board নামের এক ফেসবুক পেইজে ঘুরে দেখা গেলো, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের বিজ্ঞাপন। তাদের এক পোস্টে লেখা হয়, ‘গুচ্ছ এডমিশন ২০২১! যারা প্রশ্নপত্র নিতে চান তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। গুচ্ছ প্রশ্নপত্র দেওয়ার জন্য লিস্টে নাম নেওয়া হচ্ছে। # web officer’। যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, তালিকায় যাদের নাম উঠবে তাদেরই দেওয়া হবে প্রশ্নপত্র। তালিকায় নাম উঠানোর জন্য জমা দিতে হবে, এডমিট কার্ডের ছবি, বাবা বা মায়ের জাতীয় পরিচয় পত্রের ছবি, ব্যক্তিগত ফোন নম্বর ও ইমেইল ঠিকানা এবং ৩৫ হাজার টাকার ৫০ ভাগ।
পেইজ থেকে বলা হয়, তথ্য দিয়ে ম্যাসেজ দেওয়ার পর জানিয়ে দেওয়া হবে টাকা পাঠানোর পক্রিয়া। পরীক্ষার ২৪ ঘন্টা আগে প্রশ্নের হুবহু কপি জিমেইল করা হবে। চেইক আওয়ার পেইজ, ইনশাল্লাহ বুঝবেন আমরা কেমন ফাইন। সাবমিট দিতে চাইলে ইনফরমেশন দিয়ে ম্যাসেজ দেবেন।
তালিকায় নাম উঠানোর জন্য অগ্রীম ৫০ ভাগ টাকা দিতে অসম্মতি জানানোর ফলে এই পেইজ থেকে বøক করে দেওয়ার অভিযোগ করেন গুচ্ছের বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী নওসীন তাবাসসুম। তিনি জানান, সাজেশনের জন্য ইনবক্সে নক করতে বলে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রæপে বেশ কয়েকজন পোস্ট দিয়েছেন। নক করলে চাওয়া হয় টাকা।
নওসীন বলেন, ‘এখন তো আমাদের প্রস্তুতি শেষ। সেজন্য সবাইই সাজেশন পেলে নেয়। পরীক্ষার পর টাকা দেব বললে, ওরা রাজি হয় না। একজন ৩০ হাজার টাকা চেয়ে অগ্রীম ৫০ ভাগ দিতে বলল। তারপর আমি রিপ্লাই না দেওয়ার পরও অনেক ম্যাসেজ দেয়। অগ্রীম ৫ হাজার টাকা দিতে পারব জানানোর পর, আমার এডমিট কার্ডের ছবি নিয়ে আবার ৫০ ভাগ টাকা দিতে বলে। আমি না দেয়ায় আমাকে তাদের পেইজ থেকে বøক করে দিয়েছে’।
প্রশ্ন পেতে প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে না পারায় ওই পেইজ থেকে এই প্রতিবেদককেও বøক করে দেওয়া হয়।
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়/এঝঞ ভর্তি যুদ্ধ ও তথ্য সহায়তা কেন্দ্র গ্রুপে এমন একটি বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করা হলে রবিন হাসান নামের একজন এই প্রতিবেদককে পরীক্ষার আগের রাতে হোয়াটসঅ্যাপে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে মানবিক বিভাগের প্রশ্ন দেওয়ার কথা জানান। তবে ০১৯০৭৩৮১৭৮১ এই নগদ নম্বরে অগ্রীম ৫ হাজার টাকা পাঠাতে বলেন। খবর বিডিনিউজের
প্রশ্নগুলো কিভাবে তারা পান সেবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কী করি, কিভাবে আনব এসব বিষয় না। যেখান থেকে প্রশ্ন পাওয়া যায়, সেখানে লিঙ্কআপ আছে দেখেই দিতে পারতেছি। সরাসরি আমিই এনে দেই, আগেও দিয়েছি’।
‘তাহসিন আব্রাহাম রোসেন’ নামে ফেসবুকের একটি ফেইক অ্যাকাউন্ট থেকেও এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়েছে।
যোগাযোগ করলে বলা হয়, এ ইউনিটের প্রশ্নের জন্য ৪০ হাজার টাকা লাগবে। এজন্য উচ্চমাধ্যমিকের এডমিট কার্ডের ছবি, অভিভাবকের ফোন নম্বর এবং ৫০ ভাগ টাকা জমা দিয়ে ‘সিক্রেট কিউ’ গ্রুপে যুক্ত হতে হবে। সাজেশন কোথা থেকে পান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের এডমিন আছে ওরা দেয়’।
এডমিনরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ কিনা জানতে চাইলে তিনি সম্মতি জানান। তবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পর্যায়ে আছেন, সে বিষয়ে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের স্ক্রিনশটসহ টাকার বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের প্রশ্ন সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল পরীক্ষার আগের রাতে।