গাজ্জালিয়ে জমান অধ্যক্ষ আল্লামা মুছলেহ উদ্দিন (রহ:)

12

অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহজাহান

এ দুনিয়ায় ক্ষণে ক্ষণে প্রত্যহ কত মানব-মানবীর আগমন-প্রস্থান ঘটছে! ক’জনকেই বা আমরা স্মরণে রাখি? সবাই স্বীয় নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিতে না পারলেও কদাচিৎ এমন কিছু ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে, যাঁরা তাঁদের দেদীপ্যমান কীর্তি, দীপ্তময় কর্মকাÐ আর বহুমুখী বিস্ময়কর প্রতিভার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকেন। এমনি এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন গাজ্জালিয়ে জামান অধ্যক্ষ আল্লামা মুছলেহ উদ্দিন (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি)। যিনি নিষ্কলুষ-পঙ্কিলমুক্ত ও জৌলুসহীন পার্থিব জীবন, চারিত্রিক মাধুর্যতা এবং অনুপম আমানতদারিতার জন্য সবার হৃদয় মানসপটে চিরজাগরুক হয়ে আছেন । তিনি ১৯৩৮ সনে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার অন্তর্গত জোয়ারা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী আব্দুল আজিজ আর মাতার নাম রহিমুন্নেসা। হাশিমপুর মকবুলিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা হতে ১৯৫৪ সনে দাখিল, গারাংগিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৬ সনে আলিম, দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৮ সনে মেধা তালিকায় ১৪ তম স্থান নিয়ে ফাজিল ও ৬ষ্ঠতম স্থান নিয়ে ১৯৬০ সনে কামিল পাস করেন। আবার ১৯৬২ সনে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে এসএসসি, ১৯৬৪ সনে সিটি কলেজ থেকে এইচ এস সি এবং ১৯৬৬ ও ১৯৬৮ সনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ইতিহাস ও আরবিতে কৃতিত্বের সাথে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। জোয়ারা ইসলামিয়া, সীতাকুন্ড আলিয়া ও পটিয়া হাইদগাঁও মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মময় জীবনের সূচনা হয়। ১৯৬৪ সন থেকে ১৯৭৭ সন পর্যন্ত ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, তৎপরবর্তী থেকে ২০০৮ সন পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছোবহানিয়া কামিল মাদ্রাসায় তাঁর কর্মময় জীবনের প্রায় পুরোটা সময় অধ্যক্ষ পদে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করলেও ছাত্রদের পাঠদানের বিষয়ে তিনি কখনো কার্পণ্য করেননি। ২০০৯ সনে কয়েক বছরের জন্য চট্টগ্রাম নেছারিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় হাদিসের দরস দেন। ১৯৭৮/৭৯ সনে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নৈশকালীন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে কিছুদিন নিয়োজিত ছিলেন। ঐ কলেজ সরকারি করণ করা হলে তাঁকে হয়তো মাদ্রাসা না হয় কলেজ কোন একটি চাকরি বেছে নেয়ার জন্য বলা হয়। তিনি সানন্দে কলেজের চাকরি ত্যাগ করে মাদ্রাসার খেদমতে নিয়োজিত থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন। এমন কোন বিষয় ছিল না, যে বিষয়ে তিনি গভীর জ্ঞান রাখতেন না। বৈষয়িক জ্ঞানের পান্ডিত্যের পাশাপাশি ফতোয়া-ফারায়েজ, রাজনীতি, ধর্মনীতি, আন্তর্জাতিক ও সমসাময়িক ইসলামী শরীয়তের জটিল সমস্যাবলীর উত্তম সমাধানকারী এবং বাংলা, উর্দু, আরবি, ফার্সি, ইংরেজি সহ বহু ভাষাবিশারদ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন বলে তিনি যুগের ইমাম গাজ্জালী উপাধিতে ভূষিত হন। দর্শন বিষয়ে ব্যুৎপত্তির জন্য ছাত্ররা তাঁকে সক্রেটিস হিসাবে আখ্যায়িত করতেন। এত উঁচু মাপের মহাজ্ঞানী হয়েও তিনি অতি সাধারণ, নির্লোভ ও নিরহংকার জীবনযাপন করতেন। বাহারুল উলুম, আমানতদার ও মোত্তাকি বুজুর্গ হিসাবে তিনি সর্বমহলে সমাদৃত ছিলেন। সমসাময়িককালে মুসলমানদের বৃহত্তর ঐক্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল তাঁর জীবনের পরমব্রত। “রাহমাতুল্লিল আলামিন”, ”ইসতিজার আলা ওয়া’আত’সহ বেশ কিছু কিতাব তিনি রচনা করেন। মাওলানা আব্দুল মান্নান (ম:জি:আ): কর্তৃক অনুবাদকৃত বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ’ কানযুল ঈমান এর নিরীক্ষণ কার্যও তিনি সমাধা করেন। (যা মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে কবুল হয়েছেন বলেই স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর ইন্তেকালের কয়েক দিন পূর্বে হসপিটালে রাত তিনটায় তিনি ছরকারে দো আলম হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন ফাযেলে বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি কে জাগ্রত অবস্থায় দেখে অত্যন্ত অসুস্থ’ অবস্থায়ও দাঁড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলেন এবং মহিউদ্দিন নামক এক ছাত্রকে বলছিলেন- আমাকে দাঁড় করিয়ে দাও, আমার টুপি দাও, লাঠি দাও, আমার হুজুর এসেছেন, আ’লা হজরত এসেছেন)। তিনি ১৯৮২ সনে গঠিত জামাতে আহলে সুন্নত বাংলাদেশ’র কেন্দ্রীয় পরিষদের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। যে পরিষদের সভাপতি ছিলেন ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাযী নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ:)। তিনি ২০০৩ ও ২০০৫ সনে জাতীয় শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসাবে প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি ১৯৯১ সন থেকে মাদ্রাসা শিক্ষকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়তুল মোদার্রেসীন এর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন প্রায় ১ যুগ ধরে। মাদ্রাসা শিক্ষকদের কল্যাণে এ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি অনন্য অবদান রাখেন। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির অনন্য রূপকার ছিলেন তিনি। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বতন্ত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় ঈদ জমাত কমিটি গঠন, লালদীঘি জামে মসজিদ নির্মাণসহ অনেক ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের দাবি আদায়ে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তাঁর জ্ঞানের বিশালতার কাছে সমকালীন যুগের বিজ্ঞ আলেমগণ ছিলেন শ্রদ্ধাষ্পদ ও অবনত মস্তক। সত্যকথন আর নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। ২০১২ সনের ২১ শে জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরে তিনি ইন্তেকাল করেন। এ বছর বর্ণাঢ্য আয়োজনে এ মহান মনীষীর ১১তম ওফাতবার্ষিকী পালন করা হবে।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক