গাজী মাজহারুল আনোয়ার: সৃষ্টিতেই তিনি বেঁচে থাকবেন

42

বিনোদন ডেস্ক

কিংবদন্তি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার (৭৯) মারা গেছেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ৫৫ ‍মিনিটে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান বলে নিশ্চিত করেন গীতিকবির ভাগিনা অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয়। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের দুই সন্তান-উপল ও দিঠি। বাবার মৃত্যুর সময় ছেলে উপল পাশে থাকলেও মেয়ে দিঠি আছেন দেশের বাইরে, যুক্তরাষ্ট্রে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রæয়াারি কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে রেডিও পাকিস্তানে গান লেখা শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেন। প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখেন ১৯৬৭ সালে আয়না ও অবশিষ্ট চলচ্চিত্রের জন্য। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’সহ অসংখ্য কালজয়ী গানের ¯্রষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার ‘বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। এছাড়াও পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ডসহ তার অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ১১০। আর তার লেখা গানের সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। গত রবিবার হঠাৎ করেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি। তার চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে অবসান হলো ২০ হাজারের বেশি গান রচনিয়তার অনবদ্য এক অধ্যায়ের।
দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে বেতার, টেলিভিশন, সিনেমাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এসব গান রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এসব গানে তার কালজয়ী গানও অসংখ্য। বিবিসি বাংলার তৈরি করা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ বাংলা গানের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা তিনটি।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রথম গান লেখেন ১৯৬২ সালে। ‘বুঝেছি মনের বনে রং লেগেছে’। তবে পেশাদার গীতিকার হিসেবে জীবন শুরু হয় তার এর দুবছর পরেই। ১৯৬৪ সালে রেডিও পাকিস্তানে গান লিখে ৫০ টাকা আয় করেন। এর পর থেকে আর কলম থামাননি।
লিখে গেছেন একের পর এক হৃদয় রাঙানো গান। তার গানে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম, বিরহ, স্নেহ ও অনুভূতির কথা।
বাংলা চলচ্চিত্রে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের রচিত প্রথম গান শোনা যায় সুভাষ দত্তের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ সিনেমায়। গানটি হলো ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’। প্রথম গানেই বাজিমাত করেন মাজহারুল আনোয়ার।
এরপর থেকে একের পর এক কালজয়ী গান উপহার দিতে থাকেন এ গীতিকার। তার লেখা তার লেখা কিছু কালজয়ী গান হলো-‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’, ‘ইশারায় শীষ দিযয়ে’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে’ প্রভৃতি। একজন সফল চলচ্চিত্র পরিচালক, কাহিনিকার ও প্রযোজকও অসংখ্য গানের গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রে যুক্ত হওয়ার পর গাজী মাজহারুল আনোয়ার চিত্রনাট্য, গান, সংলাপ ও কাহিনি রচনা শুরু করেন।
দুই হাজার ছয় সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের মনোনীত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় ছিল তার রচিত ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল’ এই তিনটি গান।
যেভাবে গান লেখায় হাতেখড়ি
ষাটের দশকের শুরুতে তিনি চিকিৎসায় পড়াশুনা শুরু করেন। দুই হাজার তের সালে বিবিসি বাংলার সাথে এক কথোপকথনে তিনি বলেছিলেন, জন্মস্থান কুমিল্লায় স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি দেয়াল পত্রিকায় কবিতা লিখতেন। কবিতা লেখা কিভাবে তাকে গানের রচয়িতা করে তুলল সেটি বর্ণনা করে তিনি বলছিলেন, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর যখন মেডিকেল কলেজে এসে ভর্তি হলাম, সেখানে একটা নাটক হওয়ার কথা। সেটাতে একটা গানের প্রয়োজন হয়েছিল। গানটা সেসময়কার প্রখ্যাত আবু হেনা মোস্তফা কামাল সাহেবের লেখার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সময় স্বল্পতার কারণে গানটা লিখতে পারেননি। তো আমি সেই সময় নাটকের পরিচালককে বললাম আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে একটু ট্রাই করে দেখতে পারেন। তারপর আমি একটি গান লিখে ফেললাম। সেই গানটি পরে গেয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন। সেভাবেই রেডিওতে গানের রচয়িতা হিসেবে তার অভিষেক। তিনি (ফরিদা ইয়াসমিন) একদিন আমাকে বলেছিলেন আমি এই গানটি রেডিওতে গাইতে চাই। আমি বেশ উৎসাহিত হলাম। যদিও সেই গানের রচয়িতা হিসেবে আমার নামটা যায়নি। আমার মাথার মধ্যে তখন একটা পোকা ঢুকে গেলো যে গানতো আমি লিখতে পারি। মানুষ সৌভাগ্যের পেছনে ঘোরে। কিন্তু সৌভাগ্য যেকোনভাবে আসতে পারে। সুতরাং একেই জুড়য়ে আমি থাকলাম।
ব্যাস এরপর থেকে রেডিও পাকিস্তানের গান লেখার চেষ্টা করলেন এবং পাঁচ দশকের মতো সময় ধরে তার গানে উঠে এসেছে দেশপ্রেম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের জীবনের গল্প, প্রেম, বিরহের কথা। এই বিষয়গুলিই গান লেখায় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেগ এনে দিয়েছে, বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন তিনি।
তার লেখা গানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গীতের ক্যারিয়ারে উঠে এসেছে। তার জনপ্রিয় অনেক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহতমতউল্লাহ, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদি, সাবিনা ইয়াসমিন।
প্রথম যে গানটির মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানে শিল্পী রুনা লায়লার অভিষেক হয়েছিল সেটি তার লেখা ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি’।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালকও ছিলেন। পনেরোটির বেশি চলচ্চিত্র পরিচালনা এবং কুড়িটির বেশি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন তিনি।
সাবিনা ইয়াসমিনের স্মৃতিচারণ
তার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাবিনা ইয়াসমিন গণমাধ্যমকে বলছিলেন, “বহু বছরের অসংখ্য স্মৃতি তার সাথে আমার। তবে আমার সবচেয়ে মজার স্মৃতি হল ওনার সিনেমায় অভিনয় করা। আমিতো গান করি। কোনোদিন অভিনয় করিনি। উনি আমাকে জোর করে ওনার একটা সিনেমায় আমাকে অভিনয় করিয়েছিলেন। আমি একজন শিল্পী এবং সেই ছবিতে আমার চরিত্রটিও ছিল একজন শিল্পী। এটা আমার জন্য একটা স্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন।”
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা তাঁর সবচেয়ে পছন্দের গান সম্পর্কে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “এত দারুণ সব গান, তার মধ্যে খুব পছন্দের একটার কথা বলা মুশকিল। কিন্তু যদি বলতে হয় তার কোন গানটি আমি প্রায়ই গুনগুন করে গেয়ে উঠি সেটা হল ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়’। হারজিত সিনেমার জন্য গাওয়া হয়েছিল গানটা। অসম্ভব সুন্দর একটা গান।
যেমন লেখা তেমন সুর। “গাজী মাজহারুল আনোয়ার কুড়ি হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন। তার গানের ঝুলি কিভাবে এত ভরপুর হল সে সম্পর্কে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “একটা সময় ছিল টেলিভিশনের কোন সঙ্গীত পরিচালক, চলচ্চিত্রের অনেক প্রতিষ্ঠিত মিউজিক ডাইরেক্টর, ওনারা চাইতেন না আমার বাইরে আর কারো গান হোক। সেকারণে প্রতিদিনই কয়েকটা করে গান লেখা হয়ে যেত। বহু গানের কথা এখন আর আমার সংগ্রহেও নেই। হারিয়ে গেছে।”
“ইউ আর মাই লস্ট গেম”
রেডিওতে প্রচারিত অনেক গানের রেকর্ড মুক্তিযুদ্ধের বছর খোয়া যায়। অনেক গানের খাতাও সেবছর হারিয়ে যায়। রেডিওতে তার ক্যারিয়ার শুরু হলেও গীতিকার হিসেবে পরে অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে আরও অনেক গান লিখেছেন। তার একটি বড় অংশই ছিল চলচ্চিত্রের গান। সফলতার শীর্ষে, পরিণত বয়সে এসে ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে আমি বলি কমেরে’, ‘আছেন আমার মোক্তার’, এরকম কিছু আধ্যাত্মিক গান লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।
গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন গান লেখার নেশায় যখন মেডিকেলের পড়াশুনা ছাড়তে চেয়েছিলেন সেসময় তার বাবা খুব হতাশ হয়ে তাকে একটি চিঠি লিখে বলেছিলেন, “ইউ আর মাই লস্ট গেম।”
সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, বাবার মৃত্যুর আগেই তিনি বাংলাদেশের কালজয়ী অনেক গানের রচয়িতা হিসেবে একুশে পদক পেয়েছিলেন। তার বাবা তখন তাকে আর একটি কথা বলেছিলেন, “আমি তোকে চিঠি লিখে যে কথাটি বলেছিলাম, সেটা সঠিক নয়। যার যা পথ সেটাই সত্যি হয়।”