গাছ লাগান, পরিবেশ ও জীবন বাঁচান

524

বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী নামক একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম। এই তারিখটিতে ‘গাছ লাগান, পরিবেশ ও জীবন বাঁচান’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখা হলো। কারণ ১টি বৃক্ষ রোপণের উপর পরিবেশ ও জীবন নির্ভর করে। জীবন ও জীবিকার জন্য বনের গুরুত্ব অপরিসীম। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিবছরই দেশব্যাপি ‘জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা’ আয়োজন করে। এবার ও বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা শুরু হয়েছে। সরকার এবার নতুন একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে এতে বলা হয়েছে ‘শিক্ষায় বন প্রতিবেশ, আধুনিক বাংলাদেশ’। যা অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমার ধারণা। বৃক্ষ আমাদের অমূল্য সম্পদ। প্রকৃতি ও পরিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশগত মান উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে ১৯৭২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৭তম অধিবেশনের প্লেনারী সেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে বিশ্বব্যাপি ৫ জুন পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। আর এই দিবসের উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণরূপে সাফল্যমন্ডিত করে তুলতে বাংলাদেশে বৃক্ষরোপন অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ ধরনীর সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের অস্তিত্ব প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। আর সেখানে মানুষ ও প্রকৃতির বন্ধন অবিচ্ছেদ্য। গত ৫ জুন ২০১৯ খ্রি. সকালে ঢাকা রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা এবং জাতীয় বৃক্ষরোপন অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০১৯ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘দেশের নাগরিকদের প্রত্যেককে কর্মস্থল ও বাসস্থানে গাছ লাগানোর আহব্বান জানান’।
তিনি সন্তানদের পরিবেশ বাদী হওয়া এবং গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশন সুরক্ষা কল্পে নতুন প্রকল্প গ্রহণ কালে প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টি ও তা সংরক্ষণ এবং অধিকহারে বৃক্ষরোপনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। বৃক্ষরাজি পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলেছে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনাদিকাল থেকে বৃক্ষ অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। নির্মল পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে জানমাল রক্ষায় বৃক্ষরাজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সবুজ বন দেয় জীবনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। বন শুধুমাত্র গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত কোনো এলাকা নয় এ প্রাণের বৈচিত্রে, উদ্ভিদ বৈচিত্রে সব মিলিয়ে হলো বন। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। অধিক জনসংখ্যা আমাদের বনাঞ্চল সংরক্ষণের প্রধান অন্তরায়।
সুজলা সুফলা-শস্য শামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাবরোধ ও টেকসই জনিত বিরূপ প্রভাবরোধ ও টেকসই পরিবেশ উন্নয়ন কল্পে বিজ্ঞানভিত্তিক ও লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বন উন্নয়নও করতে হবে। গাছ বাতাস থেকে ক্ষতিকর কার্বনডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অতিপ্রয়োজনীয় অক্সিজেন নিঃসরণ করে। আধুনিক, গতিশীল ও সম্ভাবনাময় সবুজ অর্থনীতি প্রবর্তনে বন সহায়ক ভূমিকা রাখে। সমৃদ্ধ বনের সাথে সমৃদ্ধ অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতি ও প্রতিবেশ বিশেষতঃ নদী, পাহাড়, বন, বন্যপ্রাণী এবং জীববৈচিত্র সুরক্ষায় বর্তমান সরকার খুবই সচেতন। অনিবার্য ধ্বংস থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে বনভূমি ছাড়াও ভ‚-পৃষ্ঠের সর্বত্র গাছ লাগাতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্থ এই বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি এই দেশের বন বন্যপ্রাণী ও জীবনবৈচিত্র সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন এবং ১৯৭৩ সালে ‘ইধহমষধফবংয রিষফষরভব (ঢ়ৎবংবহঃধহঃরড়হ) ড়ৎফবৎ ১৯৭৩’ অধ্যাদেশ জারি করেন। সাধারণভাবে আমরা বলে থাকি যে, একটি দেশের ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বজায়কল্পে দেশের আয়তনের ২৫ ভাগ এলাকায় বন থাকা উচিত। পৃথিবীর স্থলভাগের তিনভাগের একভাগ অর্থাৎ প্রায় ৪ বিলিয়ন হেক্টর এলাকায় বন আছে। অন্য দিকে বন উজারও আশংকাভাবে বেড়েছে, প্রতিদিন বন উজার হচ্ছে প্রায় ৩৫৬০০ হেক্টর। যা বছরে দাঁড়ায় ১৩ মিলিয়ন হেক্টর। বর্তমান পৃথিবীব্যাপী মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ ০.৬২ হেক্টর যা ১৯৬০ সালের তুলনায় মাত্র অর্ধেক বনভূমি। বাংলাদেশের মাথাপিছু এ বনভূমির পরিমাণ মাত্র ০.০১৫ হেক্টরের চেয়েও কম। বন বিভিন্নভাবে আমাদের জীবনের অসীম অবদান রাখে। পৃথিবী পৃষ্ঠে বনবাজি আছে বলেই পৃথিবী নামক গ্রহটা জীবজগৎ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া সুস্বাদু খাবার পানি ধারণ, শোষণ ও জমাকরণ, বায়ুমÐলের পরিবেশ ও উন্নয়ন কাজ, বিভিন্ন কারখানার কাঁচামাল সরবরাহ, ঔষধি উদ্ভিদসহ ঔষধশিল্পে কাঁচামাল সরবরাহ, ফার্নিচার অবকাঠামোগত বিভিন্ন প্রয়োজনে কাঠ সরবরাহ, কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ, অক্সিজেন সরবরাহ সহ জনগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পৃথিবীব্যাপি কাঠ ও কাঠ জাতীয় দ্রব্য নিয়ে বছরে প্রায় ২১০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়। উষ্ণমÐলীয় বনাঞ্চলে পৃথিবীর ৫০% এবং বেশি জীব বৈচিত্র বিরাজমান। এছাড়া ৬০ মিলিয়ন আদিবাসী সম্পূর্ণরূপে জীবনজীবিকা নির্বাহে বনের উপর নির্ভরশীল। আরো ২৫০ মিলিয়ন উপজাতি বনএলাকায় জুম চাষের মাধ্যমে জীবনজীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বন ও বনজ সম্পদ পৃথিবীর প্রায় মানুষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। অনেকের জীবন জীবিকার উৎস, সুস্থ ও সুন্দর জীবন যাপনের জন্য নির্মল পরিবেশ, বন্যপশু পাখির নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি সহ সাম্প্রদিক সময়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলার জন্য বন ও বনভূমির অবদান অপরিসীম।
বাংলাদেশের সরকারি বনভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১৫.৭৮% বাংলাদেশের বনাঞ্চল তিনভাগ ১) পাহাড়িবন ২) শালবন ৩) উপকূলীয় ম্যানগ্রোভবন (সুন্দরবন)
১) পাহাড়ীবন : রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভী বাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায় পাহাড়ীবন অবস্থিত। এ সকল জেলায় সরকারি বন এবং পার্বত্য জেলার অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল সহ পাহাড়ী বনের পরিমাণ প্রায় ১৩ লক্ষ ৭৭ হাজার হেক্টর। যা দেশের আয়তনের ৯.৩৩ %।
২) শালবন (পত্র ঝরাবন) : এই ধরনের বনে শতকরা ৯০ ভাগ এলাকাজুড়ে শাল প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এ বৃক্ষের উচ্চতা ১০-২৫ মিটার পর্যন্ত হয়। এ বনের আয়তন প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার হেক্টর। যা দেশের আয়তনের প্রায় ০.৮১%।
৩) ম্যানগ্রোভ বন বা সুন্দরবন : এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে অবস্থিত। এ বনাঞ্চলের আয়তন প্রায় ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার। যা বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় শতকরা ৪.০৭ ভাগ এবং বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বন ভূমির ৪০%। এছাড়া ও গ্রামীণ বনের মধ্যে বাঁশঝাড়, আম, কাঠাল, লিচু, দেবদারু, তাল, খেজুর, সুপারি নারিকেল বাগান।
দ্ব সমুদ্র সৈকতবন এর মধ্যে ঝাউ, করমজা, পুনিয়াল, পালিতামান্দার, পানিয়ামান্দার, পরশ, হিজল, নিমিন্দা ইত্যাদি।
দ্ব জলাভূমির বন এর মধ্যে বিল, হাওর, বাওর, মরানদীর অংশ, বড় দীঘি তাছাড়াও পাহাড়ে কাপ্তাই লেক, কাট্টলি লেক, মাইনি লেক ইত্যাদি। এ সকল জলাভূমিতে হিজল, বরুল, করমজা, হারগাজা, পিটালী, জারুল, পানি বিয়াস, গুল্ম জাতীয় গাছ, বেত, ল্যান্টানা, খাগড়া, শীল কড়াই, মটর কড়াই, শিমুল বহাল ইত্যাদি জন্মায়।
দ্ব উপকূলীয় বন : ১৯৬৫ থেকে অদ্যাবধি প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর উপকূলীয় বন বাগান সৃজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সামাজিক বনায়নে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র বিমোচন, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সৃষ্টি ও পরিবেশের ভারসাম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। ১৯৮১-১৯৮২ অর্থ বছর থেকে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত ৯৪ হাজার ৯৩৯ হেক্টর এবং ৭১ হাজার ৫৬ কিলোমিটার বাগান সৃজন করা হয়েছে। সৃজিত বাগানে ৬ লক্ষ ৭৮ হাজার ৬০১ জন উপকারভোগী সম্পৃক্ত রয়েছেন। যাদের মধ্যে মহিলা উপকারী ভোগীর সংখ্যা ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৪৬৭ জন। সামাজিক বণায়নের মাধ্যমে সৃজিত বাগান সমূহ হতে ৩৯ হাজার ১০৫ হেক্টর এবং ১৬ হাজার ২৭৬ কিলোমিটার বাগান কর্তন করা হয়েছে। যার বিক্রয় মূল্য ১০৭১ কোটি ৩৪ লক্ষ ৪৪ হাজার ২৫৪ টাকা। এ যাবত উপকারভোগীর মাঝে ৩৫৬ কোটি ৮২ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫২২ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। সামাজিক বনায়নের মাধ্যনের সরকার এ যাবৎ রাজস্ব আয় করেছে ৩৮৯ কোটি ১৬ লক্ষ ২৫ হাজার ৯৫৮ টাকা। (সূত্র: বন অধিদপ্তর)
বাস্তবতার নিরিখে বনজ সম্পদ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে আসুন, সকলে গাছ লাগাই পরিবেশ ও জীবন বাঁচাই।

লেখক: স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, চসিক