গাউছে মাইজভান্ডারী (ক.) বিশেষত্ব. জন্ম ও ওফাত

408

মাওলানা মুহাম্মদ সাহাব উদ্দীন আল্ কাদেরী

আল্লাহ তা’আলার এমন কিছু প্রিয় বান্দা আছেন যাঁরা আল্লাহর নির্দেশিত এবং প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথ-মতের একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও অনুশীলনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদের অন্যতম হলেন গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহসুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.)। তিনি ছিলেন একজন ক্ষণজন্ম মহাপুরুষ। তিনি রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বংশধর এবং নূরে মুহাম্মদের ধারক ও বাহক তথা আধ্যাত্মিক উত্তারিধিকারী। তাঁর আগমন সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী, জন্মের পূর্বাভাষ, মহামনীষীগণ কর্তৃক বেলায়ত ও গাউসুল আযমিয়তের স্বীকৃতি, অসংখ্য কিরামত প্রকাশ ও আউলিয়ায়ে কিরাম সৃষ্টি তাঁকে করেছে সুমহান ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। পবিত্র কুরআনুল করিমে রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ; যাকে চান দান করেন এবং আল্লাহ বড় অনুগ্রহশীল (সুরা জুমু‘আহ আয়াত-৪)
ইমামুল আউলিয়া হুযুর গাউসুল আযম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) জন্ম গ্রহণ করলেন । তিন দিন গত হওয়ার পর রাতে তাঁর বুযুর্গ পিতা স্বপ্নে দেখলেন, হযরত মুহাম্মদ (দ.) তাঁকে বললেন ‘হে মতিউল্লাহ! তোমার ঘরে আমার প্রিয় মাহবুব আহমদ উল্লাহ আসিয়েছে।’ এটি শুনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কাকে দয়াল নবী (দ.) প্রিয় মাহবুব আহমদ উল্লাহ বলছেন। নবী পাক তাঁকে পুনরায় বললেন, ‘তোমার ঘরে আমার প্রিয় মাহবুব বিকাশ লাভ করিয়াছে। আমি নবী তাঁহার নাম আমার ‘আহমদ’ নাম আল্লাহ যুক্ত করিয়া আহমদ উল্লাহ রাখিলাম।’ এইবার তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর শিশুসন্তানের কথাই বললেন। ক্রমে সপ্তম দিবসে পদার্পন হলে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর নাম রাখার আয়োজন করা হয়, তাতে উপস্থিত আত্মীয়স্বজন নানা নাম প্রস্তাব করছেন বটে, যখনি পিতাকে নাম প্রস্তাবের কথা বলা হলো, তখন তিনি বললেন, ‘তাঁহার নাম আহমদ উল্লাহ রাখাই বাঞ্ছনীয়’। সবাই স্বপ্নে প্রদত্ত পবিত্র গুরুত্বপূর্ণ নাম শুনে খুশি হলেন। (জীবনী ও কেরামত পৃষ্ঠা নং ২১) অনুরূপভাবে হুজুরে গাউসুল আযম মাহবুবে সুবহানি শেখ সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানী (র.) এর আম্মাজান সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতিমা (রহ.)এর ভাষ্য মতে, সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী (রহ.)ও স্বপ্নে দেখে বুযুর্গ পিতা গাউসে পাকের নাম রেখেছিলেন। (কারামাতে গাউসুল আজম ১২ পৃষ্ঠা)
হযরত শায়খুল আকবর আল্লামা মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী কর্তৃক লিখিত বিখ্যাত সুফিবাদি গ্রন্থ, ফসুসুল হেকমের ৬৭ পৃষ্ঠায় ইমামুল আউলিয়া হুযুর গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী (ক.) এর জন্মের ৫৮৬ বছর পূর্বে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, “নবী করীম (দ.) এর আরবে অস্তমিত রবি এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে পুনঃউদিত হইবে। তাহার নাম থাকিবে খোদার জাতি নাম আল্লাহ এর সহিত সংমিশ্রিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বেলায়তী নাম আহমদ”। (ফসুসুল হেকম কৃত মুহীউদ্দীন ইবনে আরবী, পৃষ্ঠা ৬৭, জীবনী ও কেরামত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ১৫)
রাহমতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ মোস্তাফা (দ.) বংশধারা হযরত ইমাম হাসান (ক.) ও হযরত ইমাম হুসাইনের (ক.) উত্তারাধিকারীদের মাধ্যমে নবী বংশ বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। তারই অন্যতম বংশধর ২৬তম আওলাদে রাসুল (দ.) হযরত মৌলভী মতিউল্লাহ (ক.) এর ঔরষজাতে সৈয়দা খায়রুন্নেছা (ক.)’র গর্ভে উপমহাদেশে চট্রগ্রামের ঈছাপুরে (বর্তমান মাইজভাÐার শরীফে) হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী হযরত মাওলানা শাহ ছুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) প্রকাশ হযরত কেবলা ১৮২৬ইং সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা তৎকালীন ইসলাম ধর্মের একজন বিশিষ্ট প্রচারক ছিলেন। তাঁর বাল্যকালীন শিক্ষা গ্রাম্য মকতবে শুরু হয়। পরবর্তীতে ১২৬০ হিজরি সনে কলিকতা আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যায়ন করতে গমন করেন। তথায় ১২৬৮ হিজরি সনে কোরআন, হাদিস, তাফসির , ফেকাহ প্রভৃতি শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতার সাথে শেষ পরীক্ষায় পাশ করেন। হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী (কঃ) ১২৬৯ হিজরি সনে যশোর জেলার কাজী পদে নিয়োজিত হন। উক্ত পদে ইস্তফা দেওয়ার পর তিনি কলিকাতার মাটিয়া বুরুজে মুন্সী বুআলী সাহেবের মাদ্রাসায় অধ্যাপনায় আত্মনিয়োগ করেন। সেই সময় সুপ্রসিদ্ধ বাগদাদবাসী হযরত পীরানে পীর দস্তগীর গাউছুল আযম মুহিউদ্দীন সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী (ক.) এর বংশধর ও উক্ত তরীকার খেলাফতপ্রাপ্ত গাউছে কাওনাইন শেখ সৈয়দ আবু শামা মোহাম্মদ সালেহ লাহোরী আল কাদেরীর (কঃ) বাইয়াত হয়ে তাঁর নিকট হতে গাউছিয়তের ফয়েজ ও খেলাফত হাসেল করেন। তিনি যথার্থ জাহেরী-বাতেনী শিক্ষাদীক্ষা এবং ফয়েজ এত্তেহাদী ও এলমে লাদুন্নি হাসেল দ্বারা বেলায়তের সর্বউচ্চ মকামে অধিষ্ঠিত হন। এরপর তিনি এতদঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে বায়াত মুরিদের মাধ্যমে ত্বরিকতের তালিম দিতে শুরু করেন, এবং ত্বরিকার সূত্রপাত করেন। তিনি উনাশি বৎসর বয়সে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বেছাল হন। প্রতি বৎসর ১০ই মাঘ মাইজভাÐরি দরবার শরীফে তাঁর বার্ষিক ওরশ পালিত হয়।
বাহারুল উলুম আল্লামা মুফতি সৈয়দ আব্দুলগণি কাঞ্চনপুরী (রহ.) তাঁর ঐতিহাসিক “আয়নায়ে বারী” গ্রন্থে বলেন- “আব তাওয়াললুদ হোগায়ে গাউসে খোদা/ওয়াস্তে তা’জীম উনকে হো খাড়া।
জিসনে কি তা’জীম উন কো উনকো ক্বিয়াম/পাচুকা ফাওরান ওয়াহী দিলকা মুরাম।”
ভাবার্থ: গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (রাদ্বিঃ) এর শুভাগমন হয়েছে। তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাঁও। দাড়িয়ে তাঁকে যিনি সম্মান করেন, তিনি মনস্কাম সফল হন। তিনি আরো বলেন- ছদ মারহাবা সাল্লিআলা গাউসে খোদা পয়দা হোয়ে/ জানে জাঁহা ওয়া ক্বেবলায়ে আহলে ছফা পয়দা হোয়ে। ভাবার্থ: পৃথিবীর সমগ্র সৃষ্টি বলতে লাগল, মারহাবা ইয়া মারহাবা- গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী মারহাবা। আল্লাহর বন্ধু, পৃথিবীর প্রাণ, আল্লাহ ওয়ালাদের দিক নির্দেশনাকারী ইমাম ভবে তাশরীফ এনেছেন।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “ আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতের জন্য প্রতি শতকের শুরুতে এমন ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন যিনি ধর্মীয় সংস্কারের ভূমিকা পালন করেন।” (আবু দাউদ ও মিশকাত শরীফ) সে যুগের বড় বড় আলেমরাই ওনাকে গাউসুল আ’যম বলতেন। যেমন-বাহারুল উলুম আব্দুল গণি কাঞ্চনপুরী, মাওলানা আব্দুল হাদী কাঞ্চনপুরী (রহ.), মুফতী আল্লামা সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী, মাওলানা বজলুল করিম মন্দাকিনী মাইজভাÐারী (রহ.) ইমামে আহলে সুন্নাত ছানিয়ে ওয়ায়েসুল ক্বরণী আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক প্রকাশ ইমাম শেরে বাংলা (রহ.)। এ জন্য আল্লামা মন্দাকিনী তার ‘বিষাদ তরঙ্গে’ বলেন- কেন চিনলিনারে মন/ গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী মাওলানা কেমন।।
নৈরুপ আকার নিল, ছলে জগৎ মাতাইল/ নর-নারী হুর পেরেস্তা প্রেমেতে মগন।।
আকাশ-পাতাল আর, দেব-দেবতা তাবেদার/ যাঁহার হুকুমে চলে এই ত্রিভুবন।।
ইমামুত ত্বরীক্বত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (রাদ্বিঃ) এর ত্বরীক্বতের শায়েখ হচ্ছেন ইমামুত ত্বরীক্বত গাউসুল আ’যম জিলানী (রাদ্বিঃ) এর বংশধর ও মহান অলি শেখ হযরত সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ লাহোরী (রঃ)। এ বিষয়ের উপর উর্দু, ফার্সি, বাংলা, ইংরেজিতে অসংখ্য রচনাবলি থাকা সত্তে¡ও কেউ যদি তাঁর পীর অন্যজনকে বলেন ও প্রচার করেন, তা ইতিহাস বিকৃতিকারী। গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (রাদ্বিঃ) সময় সময়
বলতেন-‘‘আমার বারোটি সেতারা, বারোটি বুরুজ ও বারোটি কাছারী আছে” ইহা কুরআনের সূরা আলাম নাসারাহ এর বার মনজিলের ইঙ্গিতবাহী; রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বার মঞ্জিলের অনুরুপ। ইহা জিল্লে মুহাম্মদীর পরিচায়ক। সময়ে সময়ে আরো ও বলতেন-“তুমি আমার সামনে থেকেও যদি স্বরণ বিচ্যুত হও তাহলে তুমি তখন ইয়ামেন দেশের বাসিন্দা। কিন্তু স্মরণ অবস্থায় তুমি যেখানেই থাকনা কেন, তুমি আমার সামনে।” “আমি হাশরের দিন প্রথম বলিব লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইটি টুপির মধ্যে একটি টুপি আমার মাথায়, অপরটি আমার ভাই বড় পীর সাহেবের মাথায় দিয়েছেন।” আমার নাম পীরানে পীর সাহেবের নারেম সাথে সোনালী অক্ষরে লিখা আছে।” “আমি মক্কা শরীফে গিয়ে দেখিলাম রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সদর মোবারক (সিনা মোবারক) এক অনন্ত দরিয়া। আমি এবং আমার ভাই পীরানে পীর সাহেব ঐ দরিয়াতে ডুব দিলাম” “যে কেউ আমার (গাউসিয়াতের) সাহায্য প্রর্থনা করবে, আমি তাকে উম্মুক্ত সাহায্য করব। আমার (গাউসিয়াতের) সরকার এর রীতি হাশর পর্যন্ত জারি থাকবে।”
কেননা ইমাম শেরে বাংলা (রহ.) বলেন-কেরামাতাশ বেরো আজ হদ্দে শুমার আস্ত/ বছা নাক্কেছ যে ফায়যশ পুর কামাল আস্ত/ খোদা ওয়ান্দা বি হক্কে গাউসুল আ’যম/ আজিজশরা বদেহ ইজ্জে দো আলম।
ভাবার্থ : গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারীর কারামত অসীম। তাঁর বেলায়ত প্রভাবে অসংখ্য নাকেছ ব্যক্তি কামেল
অলি আল্লাহ হয়েছেন। হে আল্লাহ! গাউসুল আ’যম মাইজভাÐারীর উঠিলায় তাঁর আজিজ শেরে বাংলা) কে
উভয় জগতে ইজ্জত দান করুন। (দেওয়ানে আজিজ শরীফ ৪০ পৃষ্ঠা)
পরিশেষে কারামাতে আউলিয়া হচ্ছে মোজজায়ে আম্বিয়ারই ফসল ইসলামী আক্বিদা মতে কারামতে আউলিয়া হক ও সত্য। মৃত্যুর পরেও উক্ত কারামতে বিদ্যমান থাকে। বরং বৃদ্ধি পায় (ইমাম গাজ্জালী)। আল্লাহপাক ও তাঁর হাবীব সারওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওফিক দান করুন, অলি আল্লাহগণের পদ মর্যাদার ও গাউসুল আ’যম জিলানী এবং গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারীর সু-নজর আমাদের উপর নসিব করুন-আমিন।

লেখক : সদস্য মাইজভাÐারী গাউসিয়া হক কমিটি