গাঁয়ের পায়ে বৃষ্টি নুপূর

199

রুমঝুমের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো বাড়ি এসে। বাবা যে গ্রামের কথা বলেছে ওরকম কিচ্ছু নেই এখানে। শহরের মতো পাকা রাস্তা। বাড়িগুলো সব পাকা। কোনো কোনো বাড়ি দোতলা। বাবার কাছে রুমঝুম দাদুবাড়ির অনেক গল্প শুনেছে। স্কুলের খাতায় আর্ট টিচার যখন গ্রামের দৃশ্য আঁকতে বলতেন, রুমঝুম বাবার মুখে শোনা দাদুবাড়ির ছবি আঁকতো। যখন ঠিক হলো ঈদের ছুটিতে দাদুবাড়ি বেড়াতে আসবে রুমঝুমের সে কি আনন্দ! বাবা আমরা কি সবুজ ঢেউ দেখবো?
হ্যাঁ, মা। ধানগাছের চারায় যখন বাতাস বইবে,তখন আমরা সবুজ ঢেউ দেখবো। মেয়ের প্রশ্নের উত্তরে বলে আসিফ। সাগরের মতো ঢেউ? ঠি-ক সাগরের মতো ঢেউ। আর পুকুরের ঝাড়বাতি? তুমি আমাকে নিয়ে দেবে তো? হ্যাঁ। নিয়ে দেবো।
আর সন্ধ্যা হলে আমরা অনেকগুলো বুনোতারা ধরবো কেমন? বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে রুমঝুম।
না মা। আমরা ওদের উড়ে বেড়ানো দেখবো। ঝাঁক বেঁধে যখন ওরা ওড়ে তখন কি সুন্দর লাগে! তোমার ধরতে ইচ্ছে করবে না দেখো!
কিন্তু সত্যি সত্যি যখন দাদুবাড়ি এলো, বাবার বলা দাদুবাড়ির সাথে বাস্তবের কোনো মিল খুঁজে না পেয়ে ভীষণ মন খারাপ করে বসে আছে। আসিফ নিজেও অবাক। এই কয়বছরে এত পরিবর্তন! মেয়েকে খুব শখ করে গ্রামে নিয়ে এসেছে ঘুরতে ঈদের ছুটিতে। কিন্তু এই পরিবর্তন আসিফের মনকেও আহত করে। এই গ্রামের ছায়ায় বড় হয়েছে আসিফ। মেয়েকে নিজের গ্রাম দেখানোর পাশাপাশি একনজর দেখা হয়ে যাবে নিজের শৈশব, কৈশোর, যৌবনের কিছু অংশকেও। চারিদিকে এত পরিবর্তনের মাঝে পরিবর্তন নেই শুধু আসিফদের ঘর। সেই মাটির ঘর,টিনের চালা। ঢাকায় বাড়ি না করলে, কর্মব্যস্ততা আচ্ছন্ন করে না রাখলে হয়তো এই বাড়িও বদলে যেতো। মেয়ের দিকে তাকায়। মলিন মুখ দেখে কষ্ট হয় আসিফের। সায়মা লেগে গেছে ঘর পরিষ্কার করার কাজে।
চলো মা আমরা বড় দীঘির ঘাটে গিয়ে বসি।
বাবার হাত ধরে রুমঝুম এসে দাঁড়ায় বড় দীঘির পাড়ে। পাড় ঘেঁষে খানিকটা হেঁটে বড় একটি গাছের নীচে শানবাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসে বাবার সাথে। এত বড় দীঘি রুমঝুম আর দেখেনি। ঝিরঝিরে বাতাসে পুকুরের টলটলে পানিতে ছোটো ছোটো ঢেউ উঠছে। কি সুন্দর! রুমঝুমের মন কিছুটা ভালো দৃশ্যটা দেখে। পুকুরের চারপাশে গাছের সারি। গাছগুলোর ছায়া পানিতে পড়ে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে! রুমঝুম এমন ছায়া আর দেখেনি।
বাবা,দেখো গাছগুলো পানির নীচে কি সুন্দর লাগছে দেখতে!
মেয়ের মন কিছুটা ভালো হয়েছে দেখে ভালো লাগে আসিফের। দীঘির ওপারে কয়েকটা জমিতে ধানের কচি চারাগাছ বাতাসে দুলছে।
এখানটা একদম তোমার বলা গ্রামের মতো বাবা।
আমি যখন তোমার মতো ছোটো ছিলাম তখন এই ঘাট থেকে দেখা যেতো অনেকদূর পর্যন্ত জমি। ওখানে যে বাড়িগুলো দেখছ, তখন ওই বাড়িগুলো ছিল না। স-ব জমি। ধানের চারাগুলো দেখে মনে হতো একটি সবুজ সাগর। আমি তোমাকে ওই সবুজ সাগরের কথা বলেছি। স্কুলের সামনে খেলার মাঠ। আমরা স্কুল ছুটির পর সেই মাঠে খেলতাম।
ইস! কি মজা হতো বাবা তোমাদের! তাই না?
খুব মজা হতো মা। খেলা শেষে এই পুকুরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতাম। তোমার দাদুভাইরা বসে এই ঘাটে বসে গল্প করতেন। বেশিক্ষণ পুকুরে দাপাদাপি করছি দেখলে দিতেন ধমক!
হি হি করে হেসে ওঠে রুমঝুম। তুমি বকা খেতে বাবা? বলে আবার হাসি।
দুষ্টুমি করলে তো বকা খেতে হতো! বর্ষা কালে যখন পথ ভিজে কাদা হয়ে থাকতো, ইচ্ছে করে পিছলে পড়ে গায়ে কাদা মেখে নিতাম। শুনে তো মৌলির হাসি থামতেই চায় না।
তুমি তো খুব দুষ্টু ছিলে বাবা!
শুধু কি আমি! পাড়ার সব ছেলে। দুষ্টুমি যতোই করি,পড়ায় ফাঁকি দেবার কোনো জো ছিলনা। স্কুলের হেডস্যার রাতে আমাদের পাহারা দিতেন,পড়ছি নাকি ঘুমুচ্ছি।
ওমা! কি কড়া ছিলেন তোমাদের স্যার! চোখে আশ্চর্যের ছাপ স্পষ্ট রুমঝুমের।
আদরও করতেন তেমন। ভালো রেজাল্টের জন্য পুরস্কার পেতাম। আসিফের চোখের সামনে যেন ভাসছে সেই স্কুল, মাঠ, স্কুলের বারান্দা, ছুটির ঘণ্টার সাথে হুড়মুড় করে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসা। কাজের চাপে ভুলেই ছিল এসব। আজ এখানে বসে ছোটোবেলাটাকে বড়ো বেশি মনে পড়ছে। বাবা,ঝাড়বাতির পুকুর কই?
ওই পুকুর তো নেই মা। ওটার ওপর এখন মস্ত বাড়ি। পুকুরটার নাম ঝাড়বাতি পুকুর হওয়ার একটা গল্প আছে।
গল্পের কথা শুনতেই রুমঝুম বাবাকে ধরে বসে। ওই গল্পটা বলতেই হবে।
বার্ষিক পরিক্ষা শেষ। পরিক্ষা শেষে তখন অনেকেই গ্রামে বেড়াতে আসতো। দাদুবাড়ির সামনে কচুরিপানায় ভর্তি পুকুর তখন কচুরিপানার বেগুনী ফুলে ভর্তি। একটি ছেলে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছিল। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখিছিলাম। সে বললো,আমাকে কিছু ঝাড়বাতি ফুল তুলে এনে দেবে! বাসায় গিয়ে সবাইকে দেখাবো। তখনো ঝাড়বাতি কি আমরা দেখিনি। আন্দাজ করলাম কোন ধরণের বাতি হবে। দুষ্টুমি করে সেদিন থেকে কচুরিপানা ফুলের সেই পুকুরকে ঝাড়বাতি পুকুর নাম দিলাম। গালে হাত দিয়ে রুমঝুম শুনছিল বাবার কথা।
বাবা আমি কচুরিপানা ফুল দেখবো।
আমি তো নিজেই জানি না মা এই ফুল এখন কোথায় দেখা যায়।
আকাশ কালো হয়ে উঠেছে একদিকে। বৃষ্টি আসবে হয়তো। সন্ধ্যাও নেমে আসছে। মেয়েকে নিয়ে আসিফ ফিরে এসে দেখে বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে দিচ্ছে সায়মা।
রুমঝুম দৌঁড়ে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো,
মা,আমি আর বাবা বড় দীঘির ঘাটে বসে অনেক গল্প করেছি। বাবা যখন আমার মতো ছিল তখনকার গল্প।
মেয়ের মন ভালো হয়েছে দেখে সায়মাও খুশি।
সন্ধ্যায় চেয়ার পেতে বসে উঠোনে। মেঘলা আকাশে তারা নেই। উঠোনের এককোণে মায়ের লাগানো লেবু গাছটি আগাছার সাথে যুদ্ধ করে চারিদিকে ডালপালা ছড়িয়ে কোনরকমে মাথা তুলে আছে এখনো। স্যাঁতস্যাঁতে উঠোনে বাতাসের সাথে মিশে আছে সোঁদা গন্ধ।
মা,কেমন যেন একটা গন্ধ। চলো ঘরে যাই।
এটা গাঁয়ের গন্ধ মা। গাঁয়ের মাটির গন্ধ। মায়ের হয়ে মেয়েকে বলে আসিফ।
বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই রুমঝুম প্রায় চিৎকার দিয়ে দেখায় লেবু গাছের ঝোপের দিকে।
বুনোতারা না বাবা! টিমটিম করে আলো জ্বেলে লেবু ঝোপের আশেপাশে উড়ছে কয়েকটি জোনাকি। দৌঁড়ে যায় ওগুলো ধরতে। বেশ কিছুক্ষণ দৌঁড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে আবার এসে বাবা-মায়ের পাশে বসে পড়ে।
ঢাকায় রাত না নামলেও গ্রামের রাত খুব দ্রুত নামে। সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত রুমঝুমের চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসছে।এমন সময় বাবা হাতের তালুতে রেখে দেয় একটি জোনাকি! চমকে চোখ পুরোপুরি খুলে আনন্দে আত্মহারা। যেন সত্যি সত্যি আকাশের তারা হাতে পেয়েছে সে। কয়েক চক্কর হাতে লাগিয়েই পোকাটি আবার টিমটিম করে আলো জ্বালিয়ে উড়ে যায়।
রাতে ঘুমুতে এসেও সে আনন্দ শেষ হয় না। সায়মার প্রচন্ড ধকল গেছে। আসিফকে বলে এবার বাড়িটা পাকা করে ফেলতে। ঠিক এমন সময় ঝমঝম করে নামে বৃষ্টি। টিনের চালার উপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ। রুমঝুমের কাছেও এটি একদম নতুন।
মা,শব্দটা কেমন লাগছে? মেয়ের কাছে জানতে চায় আসিফ।
খুব মজার! নুপূরের মতো! বাবা এর নাম হবে বৃষ্টি নুপূর!
বাহ! বেশ সুন্দর নাম দিয়েছে আমার মামণি।
আমরা বৃষ্টি নুপূরের বাড়িতেই থাকবো। তাই না মা?
হ্যাঁ বাবা। শব্দটি শুনতে সায়মারও বেশ লাগছে।