গন্ডামারায় ‘মাফিয়া’ চক্রের এরা কারা?

162

বাঁশখালীর গন্ডামারায় নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে (এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট) পুলিশের গুলিতে পাঁচ শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় স্থানীয় একটি সিন্ডিকেটের ইন্ধন আছে। ঘটনার দিনও সেই সিন্ডিকেটের একজন পুলিশ নিয়ে শ্রমিকদেরকে শাসিয়ে উত্তেজিত করেছিল। এমনকি শ্রমিকদের গায়ে হাত তোলে এবং হুমকি ধমকিও দেন। যে কারণে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। ঘটনার পর শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়াতে যে চক্রটি কাজ করেছে তাদের চিহ্নিত করেছে পুলিশ।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছিল। এরমধ্যে শ্রমিকদের স্থানীয় কিছু লোক উস্কানি দিয়েছেন। এ উস্কানি কারা দিয়েছেন তাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে পুলিশ।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার মৌলভী আমিনুল্লাহর ছেলে আব্দুর রশিদই ঘটনার মূলহোতা। জামায়াত অনুসারী এই ব্যক্তি প্রকল্প এলাকার পাশে একটি মুদির দোকান করেন। প্রকল্প ঘেঁষে পূর্ব-উত্তর কোণায় মসজিদের পাশেই রশিদের বাড়ি। তার সাথে প্রকল্প এলাকায় শ্রমিক সরবরাহ করা বায়েজিদ নামে এক ব্যক্তির সুসম্পর্ক আছে। যে কারণে শ্রমিকদের মধ্যে আব্দুর রশিদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আব্দুর রশিদ নিজেও বিদ্যুৎ প্রকল্পের ছোটখাট ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। ঘটনার সময় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ আছে দেখে সুযোগটি কাজে লাগায় রশিদ। একই এলাকার এমদাদ মিয়ার সন্তান তৈয়ব, নুরুল আলমকে সাথে নিয়ে শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে অসন্তোষ বাড়িয়ে দেয়।
গন্ডামারার পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আনছার পূর্বদেশকে বলেন, ‘জামায়াতপন্থি আব্দুর রশিদের উস্কানিতেই ঘটনাটি ঘটেছে। সে প্রকল্পে লোকবল সরবরাহ দেয়া একটি পক্ষের সাথে সখ্যতা রেখে নিজেও ব্যবসা বাণিজ্য করতো। তার বাড়ির পাশেই শ্রমিকরা বসবাস করায় তার সাথে ভালো সম্পর্ক হয়। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে সে শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে অসন্তোষ বাড়িয়েছে। ঘটনার সময় শ্রমিকদের সামনে দিয়ে সে নিজেও পুলিশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল’।
পুলিশের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, ইতোমধ্যে আব্দুর রশিদ, নুরুল আলম, তৈয়বের বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর ফারুক আহমদ বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় প্ল্যান্টের ভেতরে অনধিকার প্রবেশ করে বিভিন্ন স্থাপনা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর করে ক্ষতিসাধন করে মালামাল চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে ১০ কোটি টাকার মালামাল চুরি ও ১৫ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
এস আলমের পক্ষ থেকে নিজেদের ফেসবুক পেজে জানানো হয়, প্রথম থেকেই দেশের বৃহত্তর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি বিশাল এলাকা ভিত্তিক মাফিয়া সিন্ডিকেট। এই মাফিয়া সিন্ডিকেট ভূমি দখল, ইটবালু সরবরাহ, শ্রমিক সরবরাহ, পানি সরবরাহ, খাদ্য যোগান, স্ক্রেপ কেনাবেচা থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। ঘটনার দিনও একজন ব্যক্তি পুলিশ দিয়ে শ্রমিকদের শাসিয়েছেন।
ধারণা করা হচ্ছে, শ্রমিকদের ক্ষুব্ধ করা সেই ব্যক্তি হচ্ছেন আব্দুর রশিদ।
গন্ডামারায় নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সমন্বয়কারী আদিল বিল্লাহ পূর্বদেশকে বলেন, বিদ্যুৎ প্রকল্পে কারা মাফিয়া সেটা আপনারাই বের করেন। এ মাফিয়ারা যে দলেরই হোক তারা দেশের ভালো চায় না। সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয়পার্টি এরা সবাই একই। এরা প্রধানমন্ত্রী বুঝে না। এরা মনে করে নিজেরা ঠিক থাকলেই সব। আমরা ঘটনার জন্য প্রথমে একটি পক্ষকে সন্দেহ করেছিলাম। পরে নানাভাবে জানতে পেরেছি প্রাথমিকভাবে তিনজন ব্যক্তি এই ঘটনার ইন্ধন দিয়েছেন।
গন্ডামারার ইউপি চেয়ারম্যান লেয়াকত আলী পূর্বদেশকে বলেন, ‘অবশ্যই প্রকল্পের ভেতরে একটি মাফিয়া চক্র আছে। এরা কারা পুলিশের তদন্তে বের হবে। আমি প্রকল্প এলাকায় কোনোরূপ ব্যবসা করি না। অথচ আমি বিরোধী দল করি বলে কোনো ঘটনা ঘটলেই আমাকে দোষারোপ করা হয়। আমার সাথে এস আলমের ব্যবসা বাইরে। এলাকায় আছে উন্নয়নের সম্পর্ক। ঘটনার দিনও একটি পক্ষ সেখানে উস্কানি দিয়েছে এটা ঠিক। আবার চায়নাদেরকে দোভাষীরাও কিছু ভুল বুঝিয়েছে। অথচ যে চায়নারা শ্রমিকদের সুবিধায় দু’টি মসজিদ করে দিতে পেরেছে সেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবে এমন কাজ করার কথা নয়। এরপরেও পুলিশ তদন্ত করুক। সবকিছু খোলাসা হবে’।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার সকালে শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হলে পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এছাড়াও আহত হয়েছে ২১ জন শ্রমিক ও পুলিশ। এ ঘটনায় অগ্নিসংযোগসহ পুরো প্রকল্প এলাকায় ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। ঘটনার পর থেকে এখনো পর্যন্ত সেখানের পরিস্থিতি থমথমে। এলাকায় মানুষের মধ্যে মামলা আতঙ্ক বিরাজ করছে।