গণহারে নিয়োগ দিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়লেন উপাচার্য

17

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়েন তিনি। তবে ক্যাম্পাস ত্যাগের আগে তিনি সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এডহকে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশই সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগের সদস্য বলে জানা গেছে।
অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান ২০১৭ সালে ৭ মে উপাচার্য হিসাবে চার বছরের জন্য নিয়োগ পান। নিয়োগ যোগ্যতা শিথিল করে মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ, বক্তব্যে জয় হিন্দ বলাসহ নানা বিতর্কিত কাজের জন্য মেয়াদের বেশির সময় ছিলেন আলোচনায়। সর্বশেষ আজকের বিতর্কিত এডহক নিয়োগের ফলে ক্যাম্পাসে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নিলীমা আফরোজ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে রাবিতে সব ধরনের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
সকাল থেকে উত্তেজনা : উপাচার্যের বিদায়কে কেন্দ্র করে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর থেকে তার বাসভবনের আশপাশে অবস্থান নেন চাকরি প্রত্যাশী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপাচার্যের বাসভবনের পাশে চাকরি প্রত্যাশীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সকাল নয়টার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের পাশে অবস্থান নেন দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকরা। দশটার দিকে ক্যাম্পাসে শোডাউন দেয় মহানগর ছাত্রলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী।
প্রশাসন ভবনে তালা : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ নজরুল প্রশাসন ভবনে তালা লাগানো হয়েছে। সকাল দশটার দিকে প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষকবৃন্দ ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষকরা প্রশাসন ভবনে আসেন। বিভিন্ন দফতরে কর্মরত কর্মকর্তাদের বের করে দেন। পরবর্তীতে প্রশাসন ভবনের গেটের গার্ডকে তালা দিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন।
মহানগর ছাত্রলীগের সঙ্গে রাবি ছাত্রলীগের সংঘর্ষ : এদিকে সকাল থেকে ক্যাম্পাসে খবর ছড়িয়ে পড়ে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান এডহক নিয়োগ দিয়েছেন। এতে রেজিস্ট্রার আব্দুস সালাম স্বাক্ষর করতে রাজি না হওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং সহকারী-রেজিস্ট্রার মামুনকে রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুপুর সাড়ে ১২ টায় উপাচার্যের বাসভবন থেকে সহকারী রেজিস্ট্রার মামুন-উর-রশিদ এবং রেজিস্ট্রার দফতরের সহকারী রেজিস্ট্রার তরিকুল আলম বেরিয়ে আসেন। এ সময় মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্যারিস রোডেই মামুন-অর-রশীদকে ঘিরে ধরেন। তাকে মারধর শুরু করলে হাবিবুর রহমান হলের সেকশন অফিসার আব্দুল্লাহ আল মাসুদ এগিয়ে যান। মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মাসুদকে মারধর করে তার জামা ছিঁড়ে ফেলেন। এ সময় শরীরচর্চা শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক কামরুজ্জামান চঞ্চলও তাদের মারধরের শিকার হন।
এ সময় সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি প্রত্যাশী ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মীরাও এগিয়ে গেলে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। সেখানে পুলিশ ও ডিবির সদস্যরা লাঠিপেটা করে মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মমতাজউদ্দিন কলাভবনের সামনে দিয়ে দৌড়ে ও মোটরবাইক নিয়ে পালিয়ে যান। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
সংঘর্ষের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুম মুবিন সবুজ বলেন, ‘রোজার দিন আমাদের কোনো কাজ ছিল না, তাই ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম ঘুরতে। সেখানে গিয়ে দেখি গন্ডগোল’।
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘ক্যাম্পাসে চাকরি প্রত্যাশী ও মহানগর ছাত্রলীগের মধ্যে গ্যাঞ্জাম হয়েছে। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই’।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মতিহার থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিদ্দিকুর রহমান মন্তব্য দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমরা এখন ব্যস্ত। সামগ্রিক বিষয় জেনে ডিসক্লোজ করা হবে।
সার্বিক বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অব্যাহতির বিষয়ে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, বুধবার সকালে উপাচার্য মহোদয় আমাকে ফোন করে বলেন, তিনি গাড়ি পাঠাচ্ছেন, আমি যেন আসি। বিষয়টি আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়। কারণ, আমার কাছে গাড়ি আছে। তখন আমি খবর নিয়ে জানতে পারি এডহক নিয়োগের জন্য আমাকে ডাকা হচ্ছে। তখন আমি ফোন অফ করে অন্যত্র চলে যাই। গাড়ি এসে ফিরে যায়।
অফিসে না যাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে কিনা সেটি অবগত নয় বলে জানান অধ্যাপক আব্দুস সালাম।
উপাচার্যের ক্যাম্পাস ত্যাগ ও গণহারে যোগদান : গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন উপাচার্য। এ সময় সাংবাদিকরা নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরে জানতে পারবেন’। ক্যাম্পাস ত্যাগ করার পরপরই এডহকে নিয়োগ পাওয়া ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা উপাচার্যের বাসভবনে গিয়ে যোগদান করেন।
রেজিস্ট্রার ও নিয়োগ সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা : এদিকে এডহকে কতজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ এ নিয়ে মুখ খুলছেন না। তবে চাকরি পাওয়া একাধিক সদস্য জানান, নিয়োগ পাওয়ার সংখ্যা ১৪০/১৪১। এছাড়া তাদের নিয়োগপত্রে ৫ মে উল্লেখ করা হয়েছে। নিয়োগপত্রে ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর স্বাক্ষর রয়েছে বলেও জানা গেছে।
দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকদের বক্তব্য : উপাচার্যের বিদায়বেলায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এডহক নিয়োগের আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন রাবির দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকরা। তারা বলছেন, এ নিয়োগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। পাশাপাশি সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা হলো।
দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকদের মুখপাত্র অধ্যাপক সুলতান উল ইসলাম টিপু বলেন, এ নিয়োগের ফলে পরবর্তীতে যে প্রশাসন আসবে তাকে এর মাশুল দিতে হবে। ইউজিসি যদি এডহকের বেতন দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন ক্যাম্পাসে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে।