গণপরিবহন সংকটে নাকাল

90

নগরীর ষোলশহর ২ নম্বর গেইট মোড়। এখান থেকে দেওয়ানহাট যাবেন চাকরিজীবী মো. নুরুল আমিন। আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পরও কোনো বাসের দেখা নেই। ৪০ মিনিট পর ৪ নম্বর রুটের একটি গাড়ি আসল। কিন্তু এতে ধাক্কাধাক্কি করে উঠার চেষ্টা করছেন যাত্রীরা। অনেকে গাড়ির দরজায় ‘বাদুরঝোলা’ হয়ে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় গাড়িতে উঠতে পারেননি নুরুল আমিন। এর আরও ২০ মিনিট পর আরেকটি গাড়ি আসল, এতেও আগেরটির মত অবস্থা। কোনো উপায় না দেখে ধাক্কাধাক্কি করেই তিনি উঠে গেলেন গাড়িটিতে। কিন্তু পেলেন না কোনো সিট। তাই দাঁড়িয়েই তাকে যেতে হয়েছে গন্তব্যে। গতকাল রোববার সকাল ১০টায় নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেইট মোড়ে দেখা মেলে এমন দৃশ্যের।
এভাবে আরও ৫০-৬০ জন চাকরিজীবী দাঁড়িয়ে ছিলেন বাসের অপেক্ষায়। কিন্তু গাড়ির দেখা মিলে না। তাদের প্রশ্ন, ১০ নং এবং ৮ নং রুটের বাসগুলোর গেল কোথায়?
কথা হয় কয়েকজন কর্মজীবীর সাথে। যাদের একমাত্র বাহন গণপরিবহন। স্বল্প বেতনে চাকরি করার কারণে গণপরিবহনের বিকল্প অন্যকিছু ভাবতে পারেন না বলে জানান তারা।
বেলা ১১টার দিকে জিইসি মোড় গিয়ে দেখা যায় একই দৃশ্য। গণপরিবহনের আশায় তিন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রায় শতাধিক মানুষ।
তারা বলেন, একঘণ্টা ধরে কোন গাড়িই আসেনি। যেগুলো আসছে সেগুলো যাত্রী নিচ্ছে না। যাত্রীই যদি না তোলে, তাহলে সেগুলো গণপরিবহন হল কীভাবে?
হামিদা বেগম নামে এক মহিলা বলেন, নগরীতে মহিলাদের জন্য কিছু বাস সার্ভিস ছিল, এখন সেগুলোর দেখা পাচ্ছি না। যে বাসগুলো রয়েছে, সেখানে মহিলাদের সিটে পুরুষরা বসে যান। তাহলে আমরা (নারীরা) গণপরিবহনে নিরাপদে যাত্রা করি কীভাবে? এখানে প্রায় ২০ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি অথচ একটি বাসেরও দেখা পাইনি। যেটি আসবে সেটিতে উঠতে পারবো কিনা সন্দেহ। সরকারের উচিত গণপরিবহনের দিকে ভালভাবে নজর দেওয়া।
দুপুর ১২টায় নগরীর বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে দেখা যায়, ১০ নং রুটের কিছু বাস ইউটার্ন নিয়ে পুনরায় বহদ্দারহাটের উদ্দেশে যাত্রী নিচ্ছে। অথচ বাসটির যাওয়ার কথা কাটগড় হয়ে সি-বিচ পর্যন্ত।
১০ নং রুটের এক বাসচালক আব্দুল আলিম বলেন, কাটগড় বা সি-বিচ পর্যন্ত যদি এখন যাই, তাহলে সন্ধ্যার আগে আসতে পারবো না। কারণ রাস্তা ভাঙা এবং কাভার্ডভ্যানের কারণে দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। তাই এখান থেকে ঘুরিয়ে দিয়েছি বাস। যানজটমুক্ত আর রাস্তার অবস্থা যদি ভাল থাকে, তবে আমাদের যেতে আপত্তি নেই।
কর্মজীবী শফিকুল হোসেন বলেন, যেখানে প্রতি দুই-তিন মিনিট পরপর লোকাল বাস আসার কথা, সেখানে ১৫ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট পর বাস আসছে। এতে যাত্রীদের চাপও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে যেতে হচ্ছে এসব বাসকে। অনেক সময় আমাকে দরজায় ঝুলে ঝুলে যেতে হয়।
খবর নিয়ে জানা যায়, নগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচলরত যেসব গাড়ি রয়েছে, সেগুলো ইপিজেড’র বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। সকালে অফিসে পৌঁছাবে আবার সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় পৌঁছে দিবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তার জন্য প্রতি গাড়ি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত কন্ট্রাক্ট করা হয়। সকাল-বিকেল দুইবার যাতায়াত করলে প্রতিটি ট্রিপে গাড়ির চালক-হেলপাররা দুই হাজার টাকা পেয়ে যাচ্ছে। ফলে সারাদিনের আয় তারা দুই থেকে চার ট্রিপে নিয়ে আসছে।
বাস চালক মোহাম্মদ নবী বলেন, মালিককে দৈনিক ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা দিতে হয়। আমরা সকাল এবং সন্ধ্যায় গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কন্ট্রাক্ট করে ফেলি। তাই চাহিদার টাকাটা আমাদের এখান থেকে উঠে আসে। তাই সারাদিন লোকাল ভাড়ায় বাস চালাই না।
নির্দিষ্ট রুটের গাড়ি কেন প্রতিষ্ঠানের ভাড়ায় চালান? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সারাদিন লোকাল চালিয়ে দুই হাজার টাকা পাই। আর সকাল এবং সন্ধ্যায় প্রতিষ্ঠানের হয়ে গাড়ি চালিয়ে একই টাকা পাচ্ছি। এতে কম কষ্টে বেশি উপার্জন হচ্ছে। তাই প্রতিষ্ঠানের হয়েই গাড়ি চালাচ্ছি।
ইপিজেড’র শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা রুট পারমিট রয়েছে। এমনকি এ পর্যন্ত ৬৬টি গাড়ির অনুমোদন দিয়েছে আরটিসি। আপনারা সে পারমিট নিচ্ছেন না কেন? উত্তরে তিনি বলেন, শিল্প প্রতিষ্ঠানের পারমিট ওয়ালা গাড়ির সেল ভেল্যু (বিক্রয় মূল্য) কম। তাই বিভিন্ন রুটের গাড়িগুলো প্রতিষ্ঠানের হয়ে চলে। মাঝে মাঝে পুলিশে সমস্যা করলে তখন তাদেরকেও ম্যানেজ করি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব বেলায়েত হোসেন বলেন, নগরীতে কয়েক হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করলেও গণপরিবহন সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ তারা নিজস্ব ফায়দায় ব্যস্ত কিন্তু জনদুর্ভোগের বিষয়টি তারা বিবেচনা করছেন না।
এ ব্যাপারে বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম মনজুরুল হক বলেন, নগরীতে যতগুলো গাড়ির অনুমোদন দেওয়া আছে, তা যদি ঠিকঠাক চলতো, তাহলে সংকট হতো না। পারমিট ছাড়াও কিছু গাড়ি রাস্তায় চলতে দেখা যায়। সুতরাং আমি মনে করি, পরিবহন সংকটটি কৃত্রিম। আর যে সংখ্যক গাড়ির অনুমোদন রয়েছে, তা সবসময় রাস্তায় থাকে না। এছাড়া ফিটনেসহীন কিছু গাড়ি বন্ধ থাকে। আবার মেরামতের জন্য কিছু গাড়ি গ্যারেজে থাকে। তদুপরি সকালে ও বিকালে অনেক বাস গার্মেন্টসের রিজার্ভ ভাড়ায় চলে যায়। এ কারণেও গণপরিবহন সংকটের সৃষ্টি হয়। অবিলম্বে গণপরিবহন মালিকদের এসব রিজার্ভ ভাড়া বন্ধ করতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত স্ব-স্ব কর্মীদের জন্য নিজস্ব পরিবহনের ব্যবস্থা করা।
তিনি আরও বলেন, আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছেই। এতো জরিমানা, সতর্ক করার পরও সিস্টেমের গলদের কারণে পরিস্থিতির খুব একটা উত্তরণ ঘটছে না। আজও (বৃহস্পতিবার) মাঝপথে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে বাস ঘুরিয়ে দেওয়ার অপরাধে বহদ্দারহাট মোড়ে ১০নং রুটের ছয়টি বাসকে ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছি। তার সাথে তাদের সতর্ক করে দিয়েছি।
নগর পুলিশের কমিশনার মো. মাহবুবুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, মহানগরীতে অপরিকল্পিতভাবে গণপরিবহন চলাচল করছে। এসব গাড়ির মধ্যে অধিকাংশেরই ফিটনেস নেই। তাছাড়া সবগুলো ধারণক্ষমতার বাইরেও অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করছে। নির্দিষ্ট রুট অমান্যকারী গাড়ির বিরুদ্ধে পুলিশ তৎপর রয়েছে। জরিমানা, মামলা ও জব্দ করেও কোন সমাধান হচ্ছে না। কারণ, যাত্রীর তুলনায় গণপরিবহন অপ্রতুল। বিভিন্ন অনিয়মের কারণেও অনেক গাড়ি ড্যাম্পিংয়ে যাচ্ছে।