গণতন্ত্র ও উন্নয়নে-ঐক্যই হোক মহান বিজয় দিবসের অঙ্গীকার

56

আজ মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করেছিল পাকহানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রহর থেকে শুরু হওয়া স্বশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়; এরসাথে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। নিঃসন্দেহে দিনটি আমাদের জন্য গৌরবের, বাধভাঙা আনন্দের। একই সঙ্গে দিনটি বেদনারও, বিশেষ করে যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের জন্য। স্বাধীনতাকামী অগণিত বাঙালির আত্মত্যাগের ফসল আমাদের স্বাধীনতা। আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের; যেসব নারী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন; যেসকল নারী-পুরুষ পঙ্গুত্ব হয়ে এখনও জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের। বলার আপেক্ষা রাখেনা যে, এ দেশের মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কোটি কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। আর তার সঙ্গে একই লক্ষ্যে অবিচল একদল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী একাত্ম হয়েছিলেন। তাদের সবাইকেই আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে। ৪৮ বছরের এ পথপরিক্রমায় সে স্বপ্নের কতটা পূরণ হয়েছে, আজ সে হিসাব মেলাতে চাইবে সবাই। এর মধ্যে আমাদের অনেক চড়াই-উৎরাই মোকাবেলা করতে হয়েছে। রাজনীতি এগিয়েছে অমসৃণ পথে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায়। জনবহুল ও সীমিত সম্পদের এ দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার কাজও সহজ ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন দিনগুলোয় রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র চালু করতে হয়েছিল। স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি সংবিধানও প্রণয়ন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রয়োজন ছিল গণতান্ত্রিক ও মুক্ত পরিবেশে নিরবচ্ছিন্ন যাত্রার। সদ্য স্বাধীন দেশের নেতৃত্বের এ বিষয়ে অঙ্গীকারের অভাব ছিল না। দুর্ভাগ্যজনক, একদল পথভ্রষ্ট সৈনিক ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের মহান লক্ষ্যে মারাত্মক বিচ্যুতি ঘটায় এবং জাতিকে দীর্ঘকাল ধরে তার খেসারত দিতে হয় । সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ এগারো বছর দক্ষ হাতে দেশ শাসন করে সেই অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপকহারে উন্নয়ন ঘটেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে দারিদ্র্য মানুষের হার এখনও প্রত্যাশা আনুযায়ী কমেনি। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা পেলেও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা অনেকক্ষেত্রে দৃশ্যমান। এছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর বিভক্তি; এর পাশাপাশি জাতীয় প্রশ্নে অনৈক্য আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে। দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির তৎপর রয়েই গেছে। তবে সমগ্র বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির তৎপরতা রোধে সহায়ক হবে, আশা করা যায়। এতে আইনের শাসন জোরদার করার পথও সুগম হবে। এছাড়া এবার বিজয় দিবসকে সামনে রেখে রাজাকারের তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। দেশবিরোধী শক্তিকে চিহ্নিত করতে এ তালিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সরকারের নানা উদ্যোগ ও কর্মসূচি উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। তবে অর্থনৈতিকভাবে আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধ রক্ষায় হতে হবে যতœবান। তবেই বিজয় হয়ে উঠবে অর্থবহ। যে কোনো জাতির শক্তির প্রধান উৎস ঐক্য। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন এটি। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের পেছনে কাজ করেছিল মত-পথ-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ।
আমাদের সামনে অসীম সম্ভাবনার দ্বার আজ উন্মুক্ত । দেশের স্থলভূমির সমান সমুদ্রসম্পদ আমাদের হাতে। অর্থনীতির চাকা দ্রুত এগুচ্ছে; এ মুহূর্তে মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সব সমস্যা মোকাবেলায় সচেষ্ট হলে আমাদের অগ্রগতি ঘটবে দ্রুত। এখন আমাদের এক্যবদ্ধভাবে কাজ করাই হোক বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।