খ্র্রীষ্টের পুনরুত্থান বিশ্বাসীদের জীবনের নিশ্চয়তা

22

 

ভূমিকা: খ্রীষ্টের জন্ম, কর্ম জীবন, মৃত্যু ও তাঁর পুনরুত্থান খ্রীষ্ট বিশ্বাসীদের জীবনে এক বিশাল গুরুত্ব বহন করে। প্রভু যীশুর কষ্টভোগ, ক্রশারোপন মৃত্যু এবং কবরস্থ এ সব কিছুর পিছনে ঈশ্বরের এক বিশাল পরিকল্পনা ছিল। এসব কিছুর সাথেই স্থানীয় লোকজন এমনকি স্থানীয় প্রশাসন পর্যন্ত যুক্ত ছিল, এক প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। শয়তানও চেয়েছিল যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির মাধ্যমে যীশুর অস্তিত্বকে চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত করতে পারে তাই যিহুদীদের দ্বারা প্রথম বিচার শুরু হয়। প্রথমে তাঁকে হাননের সামনে আনা হয়েছিল এবং অনেক প্রশ্ন করেছিল (যোহন ১৮:১৯-২৩ পদ)। পরবর্তীতে মহাযাজক কায়ফারের সামনে নেয়া হয়েছিল, এর পরে তাঁকে মহাসভার সামনে হাজির করা হয়েছিল। এই মহাসভা হলো ইস্রাইলীয় প্রাচীন বা বৃদ্ধ নেতাদের দলগত সভা অর্থাৎ যেখানে মহাযাজক, ফরিসী ও সাদ্দূকীয়রা মহাসভা ডাকতেন (প্রেরীত ৫:২১ পদ)। পরবর্তীতে রোমীয়দের মাধ্যমে তিন দফায় বিচার হয়। প্রথম রোমীয় বিচার শুরু হয় পিলাতের সামনে। তিনি ছিলেন যিহুদা রাজ্যের ৬ষ্ঠ রোমীয় শাসনকর্তা। যিহুদী নেতাগণ যীশুকে বধ করার কার্যটি পাকাপোক্তের লক্ষ্যে রোমীয় আদালতে অনুমোদন নিয়েছিল। রোমীদের দ্বিতীয় দফায় বিচার হয়েছিল হেরোদ এর সামনে। তৃতীয় দফায় আবার পিলাতের সামনে। পিলাতের সবচেয়ে বড় পাপ ছিল, তিনি যা সত্য বলে জানতেন, তা তিনি তার অবস্থান, মর্যাদা ও ব্যক্তিগত লাভের আশায় আপোস করেছিলেন। পিলাত জানতেন যীশু সম্পূর্ণ নির্দোষ। কথাটি তিনি কয়েকবার ঘোষণাও করেছিলেন (যোহন ১৮:৩৮ পদ, যোহন ১৯:৩৪-৬ পদ) শাসকগণ যীশুকে দোষী করতে গিয়ে নিজেরাই দোষী হয়েছেন। উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে বোঝা যায় স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসন যীশুর কষ্টভোগ, ক্রুশোরোপন মৃত্যু এবং কবরস্ত করা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিল।
খ্রীষ্টের মৃত্যু ও বিশ্বাসীর জীবন: প্রকৃত খ্রীষ্ট বিশ্বাসীরা ভালবাসা ন¤্রভাবে ও সাহসের সঙ্গে খ্রীষ্টের প্রশংসা করে। তার জন্য যে মূল্যই তাকে দিতে হোক না কেন, যেন সকল লোকের কাছে খ্রীষ্টই ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার একমাত্র পরিত্রাণের পথ রূপে প্রকাশিত হন। যীশু বলেছেন, ‘আমিই পথ, সত্য জীবন’। আমার মাধ্যমে না আসলে কেউই পিতার নিকটে আসতে পারে না। যীশুর মৃত্যু ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং একবিংশ শতাব্দির সবচেয়ে বিস্ফোরোনকর রাজনৈতিক ঘটনা ও ব্যক্তিগত ঘটনা। তাঁর মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় তিনি আমাদের জন্য কত লাঞ্ছনা, লজ্জা ও অপমান সহ্য করেছিলেন। মানুষের হয়েই তিনি এই লজ্জা ও অপমানের ক্রুশ বহন করেছিলেন। ঈশ্বর যীশুকে মৃতদের মধ্য থেকে উঠালেন এটা দেখাতে যে তিনি সঠিক ছিলেন ও তাঁর সকল দাবীই ছিল যথার্থ। রবিবার খুব সকালে তিনি মৃত্যু থেকে পুনরুত্থিত হয়ে শিষ্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন (প্রেরিত ১:৩ পদ)। তখনকার সময়ে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত ছড়াত যে এটা ছিল শিষ্যদের দর্শন, চিন্তাভাবনার ফসল। এখনও ঘটেছে তাঁর শিষ্যরা ধীরে ধীরে বিশ্বাস করলেন তারা সহজেই ফাঁদে পড়ার লোক ছিলেন না। তারা তৃণমূল স্তরের ব্যবসায়ী ছিলেন। তারা জানতেন মানুষ মারা গেলে আবার বেঁচে উঠে। এক সাক্ষাতকারে তাই যীশু নিজে তাদের পীড়াপীড়ি করলেন মাছ ভাজা খাওয়ার জন্য একথা প্রমাণ করতে যে তিনি আতœা (ভুত) ছিলেন না (লুক ২৪:৩৯-৪৩পদ)। তিনি কয়েকবারই তাঁর শিষ্যদের হাত দিয়ে ছুইয়ে দেখতে বলেছিলেন যেন তাদের বিশ্বাস ঘনিভূত হয়। এটা মৃতদেহের পুনর্জাগরণ করানো ছিল না। এটা ছিল ঈশ্বর-মানবের পুনরুত্থান বিশ্বাসীদের জীবনের ভিত্তি আরও মজবুত করে। কেননা পবিত্র বাইবেলের পুরাতন নিয়মে দেখতে পাই ইব্রীয় ভাববাদী যিশাইয়, খ্রীষ্টের জন্মের শতশত বছর আগে বলেছেন, তাকে চুর্ণ করতে সদাপ্রভুরই ইচ্ছা ছিল; তিনি তাঁকে যাতনাযুক্ত করলেন” (যিশাইয় ৫৩:১০ পদ)। যীশুর জন্মের যেমন ভাববাণী ছিল তেমনি জন্মের জন্য একজন কুমারী মেয়েকে ব্যবহার করা হয়েছিল, জন্মের সময়ে মাঠে রাখালদের দর্শন, পূর্বদেশীয় পÐিতদের গণনার ফল, জন্মের পরে তাঁর বেড়ে উঠা ও পরবর্তীতে তাঁর কর্মজীবন যেখানে ছিল অসাধারণ ব্যতিক্রমী ঘটনা প্রবাহ, বিবাহ বাটিতে জলকে দ্রাক্ষারস করা, রোগীকে সুস্থ্য করা, অন্ধকে চক্ষু দান, প্রকৃতিকে শান্ত করা, এমনকি মৃতকে জীবন দান যা ছিল পৃথিবীর কোন রক্ত মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কোন মানুষ তাঁর জাগতিক জ্ঞান বা পার্থিব ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রকৃতিকে থামানো বা মানুষের জীবন দান করা সম্ভব নয়। সেই অসম্ভবকে যিনি সম্ভব করেছেন তিনি কোন ভাবেই মানুষ হতে পারেন না। এটা হলো ঈশ্বরের একটি স্বর্গীয় পদক্ষেপ যা মানুষের জন্য ব্যবহার করেছিলেন। জন পাইপার নামে এক লেখকের লেখায় দেখা যায়, কেন যীশু মৃত্যুবরণ করতে এসেছিলেন ? এ প্রশ্নের উত্তরের তিনি পঞ্চাশটি কারণে বের করেছেন।
ভালবাসি আমাদের পুররুত্থিত যীশুকে? আমরা বলে থাকি আমি জন্মগতভাবে খ্রীষ্টিয়ান, আমার বাবা আমার দাদু এই করেছেন, সেই করেছেন আমি বর্তমানে এই করছি ইত্যাদি। আমি আমার প্রভুকে ভালবাসি, নিয়মিত গির্জায় যাই, নিয়মিত সভা সমিতি করি। আমি বিশ্বাস করি প্রভুকে, এমন অনেক কথা আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাত সারে বলে থাকি। একবার এক রবিবার গির্জা চলাকালীন সময়ে কিছু সন্ত্রাসি এসে গির্জা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বন্দুক উচু করে সকল উপাসনাকারীর দিকে তাক করে ধরল। সকলেই সন্ত্রাসীদের ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়ল, মনে মনে প্রভুকে ডাকা শুরু করল, এবং তাদের হাত থেকে কিভাবে বাঁচা যায় সেজন্য বিভিন্ন ভাবে অনুনয় বিনয় করা শুরু করল। কিন্তু বন্দুকধারীরা দরজার কাছে মাটিতে একটি ক্রশকে রেখে বললো তোমাদের ছেড়ে দেব, আমাদের কথা তোমাদের শুনতে হবে। যেব্যক্তি এই ক্রুশের উপর পা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে সেই মুক্তি পাবে। তাদের কথা শুনে সকলেই একটু দ্বিধাদ্ব›েদ্ব পরে সকলেই ক্রশের উপর পা দিয়ে গির্জা ঘড় থেকে বেরিয়ে যাওয়া শুরু করল। এক এক করে সকলেই বেরিয়ে গেল কিন্তু সর্বশেষ একটি ছোট্ট বালক গির্জা ঘরের ভিতরে ছিল যে এই কাজটি করতে অপারগতা স্বীকার করল, সে বললো আমি কোনভাবেই আমার প্রভুর গায়ে পা রেখে এই গির্জাঘর থেকে বের হতে পারব না। তোমরা আমাকে মেরে ফেললেও আমি এই কাজ করব না। কারণ আমার প্রভু আমাকে ভালবাসেন তিনি আমাকে রক্ষা করবেন, আর যদি এই মুহূর্তে তিনি রক্ষা নাও করেন তবে আমাকে রক্ষা করবেন, আর যদি এই মুহূর্তে তিনি রক্ষা নাও করেন তবে আমাকে তোমরা মেরে ফেললে আমি যীশুর কাছে চলে যাব। আর তার এই বিশ্বাস দেখে দস্যুদল তাকে না মেরে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। এই গল্প আমাদের কি শিক্ষা দেয়? দুই বন্ধুর গল্প আমরা জানি। ভাল্লুকের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এক বন্ধু আর এক বন্ধুকে ছেড়ে চলে গেল। আমাদের প্রভুকে ভালবাসি কিন্তু জাগতিক বিপদ আসলে তাকে অস্বীকার করি। কিন্তু আমাদের প্রভু তাঁর জীবন দিয়ে দিলেন, তিনি আমাদের অস্বীকার করেন নাই। তিনি এখনও ভালবাসেন। যীশু স্বর্গারোহনের পূর্বে বলেছিলেন “শান্তি আমি তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি, আমার শান্তি জগতের নয়। আমার শান্তি চিরস্থায়ী। তাঁর শান্তিকে এভাবে তুলনা করা যায়। যীশু বলেছেন, ‘হে পরিশান্ত ভরাক্রান্ত লোক সকলে তোমরা আমার কাছে আসো, আমি তোমাদের বিশ্রাম দিব’ (মথি ১:২৬ পদ)।
পুনরুত্থানের তাৎপর্য : আমাদের প্রভু যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান বিশ্বাসীর জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাইবেল ধ্যান করলে দেখতে পাই যীশুর জন্ম, জীবনকাল, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যদিয়ে একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। পুরাতন নিয়মের বিধিব্যবস্থা সাধারণ মানুষের জন্য পালন করা যেমন কঠিন ছিল তেমনি ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে মানুষকে এক কঠিন অবস্থানে ফেলে দূরে সরে যেত। কিন্তু প্রভু যীশুর আগমনের এই নতুন সূচনা মানুষকে ঈশ্বরের কাছে যেতে সাহায্য করেছে। তাঁকে বাদ দিয়ে কোন কিছু কল্পনা করা যায় না। প্রভু যীশুর পুনরুত্থান বিশ্বাসীদের ভিত্তিমূল। তাই পবিত্র বইবেল আমাদের এই সত্য শিক্ষা দেয় (১ করিন্থীয় ১৫:১৭ পদ)। আর খ্রীষ্ট যদি উত্থাপিত না হইয়া থাকেন তাহা হইলে তোমাদের বিশ্বাস অলিক বলে মনে হত। খ্রীষ্ট যদি উত্থাপিত না হতেন তাহলে আমাদের বিশ্বাস বৃথা বলে মনে হত। সুতরাং বিশ্বাসীদের এই গভীর বিশ্বাসের মূলে রয়েছে প্রভু যীশুর পুনরুত্থান। ‘একথা তো জানোই, তোমাদের সেই পৈত্রিক ঐতিহ্যের অনুসরণে তোমরা আগে যে অসার জীবনযাপন করতে, তার হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করার জন্যে মুক্তি পণ হল সেই মহামূল্য রক্ত, যিনি ছিলেন বলির এক নির্দোষ মেষশাবকেরই মতো, সেই খ্রীষ্টেরই রক্ত’(১ম পিতর ১:১৮-১৯ পদে)। সাধু মার্কের লেখার মধ্যে পাই, ‘মানবপুত্র তো সেবা পাবার জন্যে আসেনি; সে এসেছে সেবা করতে এবং বহু মানুষের মুক্তিপণ হিসাবে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে’( মার্ক ১০:৪৫ পদে) । ঈশ্বরের বাক্য পবিত্র বইবেল আমাদের তাঁর মৃত্যুর তাৎপর্য সম্পর্কে সুন্দর শিক্ষা দেয়। আমাদের পরিত্রাণ পাবার এক বিশেষ উপায় করেদিয়েছেন আমাদের প্রভু যীশু তাঁর পুনরুত্থানের মধ্যদিয়ে। পবিত্র বাইবেল দেখি যে,‘ মুখে তুমি যদি সকলের সামনে যীশুকে প্রভু বলে স্বীকার কর এবং অন্তরে যদি বিশ^াস কর যে, পরমেশ^র তাঁকে মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত করেছেন, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই পরিত্রাণ লাভ করবে’ (রোমীয় ১০: ৯ পদে)। কাজেই পরিত্রাণ বা পাপ থেকে উদ্ধার বা মুক্তির জন্য প্রভু যীশু খ্রীষ্টের মৃত্যু থেকে উত্থাপনই বিশ্বাস জীবনে তাৎপর্য বহন করে।
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রভু যীশুর জন্মের আগমনের ভবিষ্যৎবাণী জন্মগ্রহণ, তাঁর কর্মজীবন, তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থান এর সময়কার ঘটনা প্রবাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় তিনি পরাৎপর ঈশ্বর থেকে আগত এবং ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ ছিলেন এবং তিনি পৃথিবীতে আগত অন্যান্য ভাববাদী সাধু পুরুষ থেকে শক্তিশালী ছিলেন, কেননা এত পরাক্রমশক্তি কারো ছিলনা ও পবিত্র আত্মার মাধ্যমে কারও জন্ম হয় নাই।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ১। ওয়েবসাইট ও ইন্টারনেট থেকে, ২। পবিত্র বাইবেল, ৩। খ্রীষ্টন্ডলীর পিতৃগণের সঙ্গে ‘ঐশবাণী-ধ্যান’
লেখক: প্রধান শিক্ষক-
ডন্ বস্কো উচ্চ বিদ্যলয়, বান্দরবান সদর, বান্দরবার