খেলার দর্শক গ্যালারিতে এরা কারা!

26

 

আমি জানতাম অনেক আগে, যদিও অধিকাংশ মানুষ জানতে পেরেছে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে। বলছিলাম বাংলাদেশের ভিতরে বহু পাকিস্তানি থাকার কথা! আমি গাণিতিক হিসাব কষে শতকরায় প্রকাশ করে বলতে চাইনা। তবে ধারণার চেয়ে আরো অনেক বেশী বাংলাদেশের ভিতর পাকিস্তান আদর্শে বিশ্বাসী মানুষ রয়েছে। আমরা যারা ব্যক্তিগত কিংবা পেশাগত কারণে পথে ঘাটে মাঠে গণমানুষের সাথে মিশতে হয়, বিভিন্ন সভা সমিতিতে যেতে হয়, আমরা এই বিষয়টি জানতে বা বুঝতে পারি।
বাংলাদেশের ভিতরে বহু পাকিস্তানি থাকার কথা মানে ১৯৭১ সালে আটকে পড়া পাকিস্তান প্রদেশের বিহারি, যাদেরকে পাকিস্তান সরকার ফিরিয়ে নিচ্ছে না, তাদের কথা বলছিনা। বলছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মগ্রহণ করা নাগরিক, যারা পাকিস্তানের কৃষ্টি সংস্কৃতি ভাষা আদর্শে বিশ্বাসী, সেই পাকিস্তানপ্রেমি নব্য রাজাকারের কথা বলছিলাম।
মীরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি সিরিজ ম্যাচ চলাকালীন সেদিন বেশকিছু তরুণ পাকিস্তানের জার্সি পরে পাকিস্তানের পতাকা হাতে নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগানে মুখরিত করে তুলেছিল গ্যালারি। পাকিস্তান রান করতে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল একদল তরুণ। পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে তাতে কোন অপরাধ বা সমস্যা নয়। যে কেউ বা যে কোন নাগরিক, ক্রীড়া সংস্কৃতি বিনোদন বিষয়ে সমর্থনের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যদি ক্রীড়া বা খেলাধুলায় বাংলাদেশকে সমর্থন না করে, বিপরীতে বাংলাদেশ বিরোধী কোন শত্রæ রাষ্ট্রকে সমর্থন করে, তাহলে কিছু লেখার বা বলার মত ভাষা থাকেনা। তারপরেও বলছি, এটা ভারত পাকিস্তানের খেলা নয় যে ঢালাও ভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করবে, কিংবা ভারতের বিরোধিতা করবে। স্বাধীনদেশের নাগরিক হয়ে স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে নিজদেশের বিপক্ষে গিয়ে অন্যদেশ কে সমর্থন করবে, তা কোন ভাবে মেনে নেয়া যায়না। নতুন প্রজন্মের এই সকল ছাত্র যুবক যদি নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে আসীন হয়, তখন দেশ ও জাতির অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজে অনুমেয়। তাই বিষয়টিকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
যে কথা বলছিলাম এরা নব্যরাজাকার! মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সকল রাজাকার স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তাদের চেয়েও এই নব্যরাজাকার বেশ ভয়ানক। কারণ রাজাকারের বাংলা অর্থ হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক। তারা শান্তি কমিটি নামক সংগঠন বা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। এককথায় অখন্ড পাকিস্তান চেয়েছিল। যদি এরা রাজাকার হয়েও মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকা থেকে বিরত থাকত, তাহলে হয়ত অপরাধী হিসাবে বিশেষভাবে এত বেশী চিহ্নিত হত না। কিন্তু যারা স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, বাঙ্গালী জাতিসত্তা সংস্কৃতি ভাষা ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে, বাংলার আকাশ বাতাস আলো ছায়ায় বেড়ে উঠেছে, তারা পাকিস্তানের পক্ষে নিজের দেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রীয় নীতি,স্বদেশপ্রীতি, মূল্যবোধ সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার পরিপন্থী কাজ করেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। আর এই বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ বা দ্বিমত থাকা মানে সেও একই চিন্তার চেতনার মানুষ এবং সমান অপরাধী মনে করতে হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবিধি অনুযায়ী দেশে কোন্ কোন্ নির্দিষ্ট স্থানে বিদেশি পতাকা উত্তোলন করা যাবে, সেই বিষয়ে নীতিমালা রয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে যে সকল জায়গায় বিদেশি পতাকা উত্তোলন করার অনুমতি রয়েছে, সেই সকল স্থানে ভিনদেশের পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকাও ডানদিকে সম্মানজনকভাবে উত্তোলন করতে হবে। তবে স্টেডিয়ামের গ্যালারির মত জায়গায় নয়, সরকার অনুমোদিত সুনির্দিষ্ট স্থানে, যেখানে বিদেশি পতাকা উত্তোলনের অনুমতি রয়েছে। তাই অনেকেই এই আইন অমান্যকারীদের চিহ্নিত করে আইন প্রয়োগ করে, বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবী করেছে বা করে যাচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সব সমস্যা আইন প্রয়োগ করে সমাধান হয়না। এরা আইন বিচার শাস্তির ভয়ে পতাকার উত্তোলনের মত বাহ্যিক গর্হিত অপরাধ থেকে বিরত থাকলেও, মাত্রিকভাবে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন না হলে, আগামীতে সমস্যা আরো জটিল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই যতদিন না ভিতর থেকে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত না হবে, ততদিন আইন প্রণয়ন বা প্রয়োগ করে কিছুই হবেনা। এখানে কেন স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে স্বদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিবে তা ভাবতে হবে, অনুস›ধান করে দেখতে হবে। এই বিষয়ে আরো একটি কথা যুক্ত না করলে হয়না। কথাটি হচ্ছে আমাদের শিক্ষাক্রমে সংযোজিত বিষয় ও বিষয়বস্তুর কোথাও না কোথাও নিশ্চয় ত্রুটি রয়েছে; কিংবা ত্রুটিহীন শিক্ষাক্রম মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে ধরে নিতে হবে।
সরকার বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে দেশের জাতীয় সংস্কৃতি কৃষ্টি প্রচার করে নাগরিকের জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি জাতীয় দিবস যথাযোগ্য ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালনের জন্যে সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি প্রেরণ করে থাকে। অনেকক্ষেত্রে এই দিবস পালনে ব্যয় নির্বাহ বা চাহিদা ভিত্তিক অর্থের যোগান দিয়ে থাকে। কিন্তু ঐ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা দপ্তরে আদৌ কি জাতীয় দিবসের কোন অনুষ্ঠান হয়, নাকি জাতীয় দিবসের নামে বিজাতীয় সংস্কৃতি পালন বা প্রচার করা হয় তাও বিভিন্নভাবে তদারকি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সুন্দর দেহ বা সুশ্রী চেহারা হওয়া অপেক্ষা সুন্দর মনের মানুষ হওয়া সকলের বাঞ্চনীয়। একই ভাবে দেশ উন্নত হবার পাশাপাশি মানুষের মন উন্নত হওয়া কাম্য। অন্যথায় ভবিষ্যত প্রজন্ম কোন এক সময় তিমির আচ্ছন্ন দুর্যোগ রাত্রির দিকভ্রান্ত যাত্রিতে পরিণত হবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট