খুলে গেল স্বপ্ন দুয়ার

18

ঢাকা প্রতিনিধি

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কঠিন চ্যালেঞ্জ আর প্রতিকূলতা পেরিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল জাতি, তা বাস্তবে রূপ নিলো। মাওয়ায় পদ্মার তীরে উন্মোচিত হল ফলক, বাতাসে উড়ল রঙিন আবির, বর্ণিল উৎসবে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই এলো ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তটি। দেশের মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন তিনি। পদ্মার বুকে গৌরবের প্রতীক পদ্মা সেতুর দুয়ার খুলে দেয়া হলো। সেইসাথে খুলে গেল স্বপ্নের দ্বার। আজ থেকে চলবে যানবাহন।
গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশের পর মাওয়া প্রান্তে সুইচ টিপে সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। আর এর মাধ্যমেই খুলে গেল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অপরাপর অংশের জন্য সংযোগ, যোগাযোগ ও সম্ভাবনার অনন্ত দুয়ার।
উদ্বোধনের আগে মাওয়া প্রান্তে এক সুধী সমাবেশে দেয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, শত প্রতিক‚ল অবস্থার মধ্যেও এই সেতু নির্মাণের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে আজ বহু-কাক্সিক্ষত সেতু দাঁড়িয়ে আছে। এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহার কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয় এ সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, আমসাদের সাহসিকতা,সহনশীলতা আর জেদ।
শেখ হাসিনা বলেন, সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেলপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের একদিকে দীর্ঘদিনের ভোগান্তির লাঘব হবে, অন্যদিকে অর্থনীতি হবে বেগবান। …আশা করা হচ্ছে এ সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এক দশমিক দুই-তিন শতাংশ হারে অবদান রাখবে এবং প্রতি বছর দশমিক আট-চার শতাংশ হারে দারিদ্র বিমোচন হবে।
বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক ডাক টিকিট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০০ টাকার নোটের মোড়ক উন্মোচন করেন।
এর আগে সকাল ১০টা ৫ মিনিটে পদ্মা সেতুর থিম সং পরিবেশনের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সেতু উদ্বোধন করতে হেলিকপ্টারে পদ্মার মাওয়া প্রান্তে পৌঁছান শেখ হাসিনা ও তার সফরসঙ্গীরা।
ম্যুরাল-১ উদ্বোধনের আগে নির্ধারিত মঞ্চে সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম স্বাগত বক্তব্য রাখেন। পরে বক্তব্য রাখেন সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠানের সভাপতি সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
আগে যে পথ ফেরির মাধ্যমে পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেতো, এখন সেটি পার হওয়া যাবে মাত্র সাত মিনিটে। সবার ব্যবহারের জন্য আজ সকাল থেকে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হবে। দ্বিতল এই সেতুতে রেল চলাচলের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে রেল সংযোগের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে বলে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন। এসব জেলায় এর মধ্যেই সেতু ঘিরে নানারকম অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হয়েছে।
পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের তোলা কথিত দুর্নীতির অভিযোগে বহু নাটকীয়তার পর সেই সেতুর কাজ শুরু হতে আরও চার বছর লেগে যায়।
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বিভক্ত করা পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে একটি সেতু তৈরির পরিকল্পনা প্রথম শুরু হয় ১৯৯৯ সাল। সেই বছরের মে মাসে সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই পরীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) শুরু হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে সেতু নির্মাণ কেন দরকার, কী সুবিধা হবে, নির্মাণ ব্যয় কেমন হতে পারে ইত্যাদি বিষয় যাচাই করে দেখা হয়।
২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একনেকের বৈঠকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৫ সালের মধ্যে সেতু নির্মাণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই বছর পদ্মা সেতুর বিশদ নকশা প্রণয়নে দরপত্রও আহব্বান করা হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে, সেখানেও পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তখন ঠিক করা হয়েছিল, ২০১১ সালেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে। ক্ষমতায় আসার পরেই ২০০৯ সালের নকশা প্রণয়নের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়।
দুই হাজার এগার সালের পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশোধিত পরিকল্পনা নেয়া হয়। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের পরিকল্পনায় রেল সেতুর বিষয়টি না থাকলেও সংশোধিত পরিকল্পনায় রেল চলাচলের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সব মিলিয়ে সেতু নির্মাণের খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
সেতু নির্মাণে অর্থের বড় যোগান দেয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। তাদের সঙ্গে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) অর্থ যোগান দেয়ার কথা ছিল। আর বাংলাদেশ সরকার বাকি অর্থ খরচ করবে। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক চুক্তি থেকে সরে যায়। পরে অন্য সংস্থাগুলোও সরে যায়। যদিও পরে সেই দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
২০১২ সালের ৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য মালয়েশিয়ার তরফ থেকেই একটি প্রস্তাব এসেছিল, যদিও তার বেশি অগ্রগতি হয়নি। সরকার নিজস্ব অর্থেই পদ্মা সেতুর নির্মাণের বিষয়ে জোর পরিকল্পনা শুরু করে। দুই হাজার চৌদ্দ সালের নভেম্বর মাস থেকে পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। পদ্মা সেতুর ওপর প্রথম স্প্যান বসে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
পদ্মা সেতুতে গাড়ির লেন থাকবে একেক পাশে দুটো করে এবং একটি ব্রেকডাউন লেন। অর্থাৎ মোট ছয় লেনের ব্রিজ হচ্ছে, যদিও একে বলা হচ্ছে ফোর লেনের ব্রিজ।
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় নয় কিলোমিটার। দ্বিতল পদ্মা সেতুর এক অংশ থাকবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায়, আরেক অংশ শরীয়তপুরের জাজিরায়। সেতুর ওপরে গাড়ি চলাচল করবে, রেল চলবে নিচের অংশে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এই বছরের ২১ জুন পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।