খুন এবং হত্যা অতঃপর কিছু কথা

327

দেশে আর কয়টা খুন এবং হত্যা হলে, খুনি আর হত্যাকারীর তৃপ্তি মিটবে, বিবেকবোধ জাগ্রত হবে, আবেগআপ্লুত হবে, একটু নড়েচড়ে বসবে, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে, তওবা-ইস্তিগফার করবে, রাষ্ট্রযন্ত্রের টনক নড়বে! ইত্যাদি বিষয়ে নানা রকম ভাবনা এখন আমার মাথায় ঝেকে বসেছে। কেন এত হত্যা, কেন এত খুন? খুন এবং নরহত্যা একটি অপরটির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। এখানে খুন এবং হত্যা সাধারণ ক্ষেত্রে বা আভিধানিক অর্থে একই মনে হলেও আইন বিজ্ঞানে কিন্তু পার্থক্য বা ভিন্নতা রয়েছে। এই বিষয়ে পরে আসছি, তার আগে বলে রাখি দেশে যে পরিমান খুন হত্যা হচ্ছে, সেই তুলনায় কয়টার শাস্তি হচ্ছে? প্রতিদিন গড়ে দশটি খুন বা হত্যা হলে প্রতিদিন দশটি ফাঁসি বা এ জাতীয় শাস্তি হবার কথা। মানুষ মানুষকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করছে, জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারছে, অথৈ জলে ডুবিয়ে মৃত্যু ঘটাচ্ছে, সাপের মত পিটিয়ে মারছে এই কোন জমানায় এসে পৌঁছলাম কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা।
এখানে খুন বা হত্যার প্রকৃতি ভিন্ন হলেও সকল প্রকার খুনের যেমন অপূরণীয় ক্ষতি তেমনি মৃত্যুর যন্ত্রণাও একই। যদিও প্রকাশ্যে বরগুনায় স্ত্রীসহ অনেকের সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা কিংবা ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহানকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা প্রযুক্তির কল্যাণে ধারণকৃত ভিডিও বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে, সাধারণ মানুষ আবেগ আপ্লুত হয়, অনেকের বিবেক জাগ্রত হয়, সর্বোপরি গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। গত কয়বছরে দেশে যে খুন হত্যা হয়েছে, তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বীভৎস বিকৃত লোমহর্ষক অবিশ্বাস্য ধরনের নৃশংস খুন হত্যার মত অনেক ঘটনা ঘটেছে। অবিশ্বাস্য বলছি এই জন্যে পিতা খুন করছে সন্তানকে, সন্তান হত্যা করছে পিতা বা মাতাকে, স্ত্রী স্বামীকে খুন করছে, স্বামী স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারছে, ভাই কাটছে নিজের ভাইকে। আর এসব ঘটছে কখনো প্রকাশ্যে সবার সামনে, আবার কখনোবা চুপিসারে গোপনে। এই বীভৎস লোমহর্ষক খুন হত্যা বিশ্লেষণ করলে আরো দেখা যায়, লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে ফ্রিজের ভিতর বা ওয়্যার ড্রপের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা, কখনো রাস্তার ড্রেনে ডাস্টবিনে বা পানির ট্যাংকে ফেলে রাখা, আবার কখনো শয়নকক্ষে মাটি খুড়ে লুকিয়ে রাখা, কিংবা ইটের ভাটায় বা চুলার নিচে গুম করে রাখা ইত্যাদি। আরো দেখা যাচ্ছে, মানুষের বিচ্ছিন্ন মাথা পাওয়া যাচ্ছে একজায়গায়, হাত পা পাওয়া যাচ্ছে অন্য জায়গায়, দেহ আছে কোথায় তার কোন হদিস বা অস্তিত্ব নাই!
যেমন- নরসিংদীতে ২৩ বছর বয়সী মাহফুজ সরকার নামে এক কলেজ ছাত্রকে টুকরো টুকরো করে ডিপ ফ্রিজে লুকিয়ে রেখেছিল, চট্টগ্রামের রাউজানে দুদুমিয়াকে খুন করে মাটি চাপা দিয়ে চুলা বানিয়ে ১০ দিন যাবৎ সেই চুলাতে রান্নাবান্না কাজ চালিয়ে গিয়েছিল নিজের স্ত্রী। বরিশালের বাকেরগঞ্জে ওহাব খান নামক এক পিতা নিজের ১৭ বছর বয়সী পুত্র সন্তানকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে, রাজধানীর মিরপুরে সালাউদ্দীন নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে লেপ চাদর দিয়ে মুড়ে ওয়্যার ড্রোবে লুকিয়ে রেখেছিল তার স্ত্রী। সাভারে আশুলিয়ায় মেহেদী হাসান টিপু নামক একজনকে ৮ টুকরা করে ফ্রিজে রেখে দেয়া, রাজশাহীর তানোরে মোমেনা বেগম শাশুড়ীকে হত্যা করে চুলার নিচে গুম করে রাখা, আর ১৪ বছর বয়সী কিশোরী ঐশি রহমান একাই মা বাবাকে হত্যা করে সাড়া দেশের মানুষকে রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছিল! এইরকম ঘটনা একটি দুটি নয়, অসংখ্য খবর রয়েছে সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। আর এই সকল খুনখারাবি হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, পারিবারিক সমস্যা, অনৈতিক পরকীয়া, জঙ্গীবাদ, অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্য, জমিজমা বিরোধ, এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়া ইত্যাদি মুখ্য কারণ।
শুরুতে যে কথা বলছিলাম বা বলতে চেয়েছিলাম, সাধারণ দৃষ্টিতে ‘খুন’ এবং ‘নরহত্যা’ একই মনে হলেও দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আইন বিজ্ঞান একটি বিশাল বিষয়, এর পরিধি অনেক। এই বিষয়ে কোন ধারা-উপধারা ব্যাখ্যা প্রদান সহজ কথা নয়। আইনের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে যে সামান্যটুকু জেনেছি, সেই অনুযায়ী অতিসংক্ষেপে বলতে পারি; খুন হচ্ছে যে কাজ দ্বারা মৃত্যু সংঘঠিত হয়, এবং যেসব আঘাতের ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে বলে আঘাত প্রদানকারী জানত বা আঘাতটির স্বাভাবিক গতি মৃত্যু ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট হয় তবে সেটা হবে খুন। যা দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩০০ ধারাতে এসম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া আছে। আর এই ধরনের অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীর ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদÐ, যাবজ্জীবন ও অর্থদÐ দÐিত হবে।
অপরদিকে ২৯৯ ধারাতে নরহত্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে, মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে কোন কাজের মাধ্যমে যদি মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা থাকে, তাকে অপরাধমূলক নরহত্যা বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদন্ড কিংবা ১০ বছর মেয়াদে সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড, তদুপরি অর্থদন্ডেও দÐিত করা যাবে। এই বিষয়ে ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে বুৃঝানো যেতে পারে, কামাল চাবুক বা লাঠি দিয়ে কমলকে মারতে থাকে। সে এমন ভাবে প্রহার করতে থাকে, কমল সরল মনে বিশ্বাস করে, তার আত্মরক্ষার আর উপায় নাই। তখন কমলের পাল্টা আঘাতে কামাল নিহত হলে এক্ষেত্রে কমল নরহত্যা করেছে বলে গণ্য হবে। আর কমল নিহত হলে কামাল কর্তৃক খুন হয়েছে বলে গন্য হবে। আইনশাস্ত্রে খুন ও নরহত্যা সম্পর্কে এই ধরনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়া আছে।
যা হোক, এই বিষয় নিয়ে আইনি ব্যাখ্যা দেবার উদ্দেশ্যে আজকের লেখা নয়। তবে বলতে চাই, খুন হোক আর নরহত্যা হোক, আইন অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর এই শাস্তির কথা যখন বলছি তাই শাস্তি সম্পর্কে আমার মতামত নিয়ে কিছু কথা বলতে হয়। শাস্তির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কৃত অপরাধের জন্য অপরাধীকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেয়া। কিন্তু আইন অনুযায়ী শাস্তি হচ্ছে, সমাজকে সংরক্ষণ ও শৃঙ্খলার দিকে নির্বাহকল্পে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের মূল উৎপাটনের নিমিত্তে, রাষ্ট্রকর্তৃক কর্তৃত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের দ্বারা গৃহীত নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ।
শাস্তির উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি অনুযায়ী, ফৌজদারী আদালত কর্তৃক এই শাস্তিকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এইগুলো হল (১)প্রতিশোধমূলক শাস্তি, (২)দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, (৩)নিবারণমূলক শাস্তি, (৪)প্রায়শ্চিত্যমূলক শাস্তি, (৫)সংস্কারমূলক শাস্তি। এই পাঁচ প্রকার শাস্তির মধ্যে দেখা যায় অধিকাংশ মানুষ, অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে থাকে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে, অপরাধীকে এমন শাস্তি প্রদান করা, যাতে করে অন্যান্য মানুষ একই ধরনের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত থাকে। আমি কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পক্ষে নয়। আজকের লেখায় উল্লেখিত নৃশংস বীভৎস খুন হত্যার জন্যে আমি মনেকরি প্রতিশোধমূলক শাস্তি প্রদান প্রয়োজন। প্রতিশোধমূলক শাস্তিকে যদিও প্রাচীনকালের শাস্তি বলা হয়ে থাকে, তারপরেও বর্তমান সময়ে সংঘটিত অপরাধসমূহের জন্যে প্রতিশোধমূলক শাস্তির যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে আমি মনে করি। এই শাস্তির মূলনীতি হচ্ছে, ‘চোখের বদলে চোখ আর দাঁতের বদলে দাঁত’ উপড়ে ফেলা। অর্থাৎ অপরাধী যেভাবে অপরাধ করবে তাকে ঠিক সেইভাবে শাস্তি দেয়া। যেমন যে ব্যক্তি টুকরো টুকরো করে হত্যা করেছে, তাকেও টুকরো টুকরো করে হত্যা করতে হবে। যে ব্যক্তি পুড়িয়ে হত্যা করেছে তাকেও পুড়িয়ে হত্যা করতে হবে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে এই ধরণের শাস্তি প্রদান অনেকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলতে পারে; তাহলে আমাকে বলতে হয়, যে হত্যাগুলো সংগঠিত হয়েছে সেই গুলো কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়?
দেশ এখন খুন হত্যা ও অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। মানুষ অপরাধ করেও প্রকাশ্যে দিব্যি চলাফেরা করছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ অভিযোগ করতে ভয় পায়। সত্য কথা বলতে বা সাক্ষ্য দিতে ভয় পাচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিভিন্ন কারণে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে। এই সকল বিষয়গুলো কেন জানি আমার ভাবনায় চলে আসে। যদিও আমি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কোন পদে থেকে প্রতিকার প্রতিরোধ বা প্রতিহত করার সক্ষমতা আমার নেই, তাই সমাজসচেতন ও প্রতিবাদস্বরূপ কিছু লেখার চেষ্টা করি, আর এতে করে মনের ক্ষোভ মানুষের সাথে শেয়ার হয়, নিজে কিছুটা সান্তনা পায়। আর আজকের এই লেখাটি লেখার আগ্রহ সৃষ্টি হল গত কয়দিন আগে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পিতা আব্দুল বাছির কর্তৃক ফুলের মত শিশুপুত্র তুহিনকে হত্যার বিভৎস ছবিটি দেখে। এছাড়া কুমিল্লার আদালতে বিচারকের খাস কামরায় ঢুকে, বিচারকের সামনে ফারুক নামে একজন আসামিকে উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে হত্যা, আবার মাস কয়েক আগে চলেছিল ছেলেধরা নামে গণপিটনির মাধ্যমে হত্যার মহোৎসব, এইসব তো ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছেই!
সমাজে এমন অবস্থাগুলো দেখে নিশ্চয় আমার মত অনেক সাধারণ মানুষ ভাবছে বা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে এইসব অবস্থা নিয়ে ভাবলে চলবেনা, কি করতে হবে সেই বিষয়ে ভাবতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় হতে বাঁচতে হলে সমাজকে সচেতন করে তুলতে হবে। এই দায়িত্ব কেবল সরকারের একা নয় এই দায়িত্ব আমাদের সকলের। আর এই দায়িত্ব পালন করতে হলে আমাদের শিশুদের শৈশব থেকে ধর্মীয় অনুশাসন, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা পাস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। যে কথা আগের একটি লেখায় বলেছিলাম, আমার মত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের চেয়ে, শান্তি ও শৃঙ্খলাবদ্ধ রাষ্ট্র প্রত্যাশা ও কাম্য। শুরুতেই একটি কথায় বলে ফেলেছি, আর কত চাঞ্চল্যকর খুন বা হত্যা হলে রাষ্ট্রযন্ত্রের টনক নড়বে, এখানে রাষ্ট্রে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, অপরাধীকে আইনের আওতায় ধরে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করবে এটা ঠিক, কিন্তু নৈতিক সৎ নাগরিক হবার উপায় কিন্তু ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য ও সমাজকর্মীদের আরো সক্রিয় হতে হবে। একইসাথে সরকারকেও আরো বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও সাহিত্যিক