খাদ্য নিরাপত্তা মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরির্বতন জরুরি

19

মোহাম্মদ শাহজাহান

কৃষি আমাদের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কৃষি জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা প্রদান ছাড়াও কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল সরবরাহ করে। সামগ্রিক অর্থে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর ৭ কোটি থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার, সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন সম্ভাবনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিশ্চয়তা সত্তে¡ও আমরা উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অর্জনে সক্ষম হয়েছি। জনগণের মাথাপিছু আয় ক্রমাগত বৃদ্ধির পাশাপাশি মৌলিক মানব উন্নয়ন সূচকের মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও আমাদের সাফল্য অভূতপূর্ব। যদিও দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এখনো আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। যেমন উচ্চমাত্রার দারিদ্র্য, বৈষম্য বৃদ্ধি ও অনমনীয় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং অপরিকল্পিত ভূমির ব্যবহারের ফলে ক্রমহ্রাসমান ভূমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান দেওয়া বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
সত্যিটা হচ্ছে, এখনো এদেশের লাখো মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি এবং এ সংখ্যা অনেকটা অদৃশ্যমান। কারণ এ মানুষগুলোর বসবাস কেন্দ্রীয় ক্ষমতাবলয় থেকে অনেক দূরে। পরিবারের ভরণপোষণের নিমিত্তে তাদের প্রতিদিন রীতিমতো লড়াইয়ে নামতে হয়। সাধারণত খাদ্যঘাটতির বিষয়টি কালেভদ্রে পত্রিকার শিরোনামে উঠে আসে; কিন্তু এ ধরনের জরুরি অবস্থা ব্যতীত খাদ্যঘাটতি নিয়ে খুব একটা আলাপ হয় না। তবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অপুষ্টির জন্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে উন্নয়নের সুফল সুষমভাবে দরিদ্র্যদের কাছে না পৌঁছানো, ধনীদের তুলনায় দরিদ্রদের আর্থিক অবস্থা থেকে উত্তরণের শ্লথ গতি, কৃষির উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া এবং কৃষি উৎপাদন গুটি কয়েক ফসলের ওপর নির্ভরশীল হওয়া। এরকম আরো নানা কারণে সবুজ বিপ্লবে উদ্ভাবিত অতি উচ্চ উপকরণ নির্ভর প্রযুক্তিসমূহের প্রয়োগে শুধু যে কাক্সিক্ষত ফলন লাভ হচ্ছে না তা নয়, প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশে নানা রকম দীর্ঘমেয়াদী কু-প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে কৃষিজমি ও পরিবেশ বিপন্ন হতে চলেছে। শুধু তাই নয় অপরিকল্পিত রাসায়নিক পদার্থের যেমন, সিনথেটিক কীটনাশক, সার ব্যবহার ও শিল্প বর্জ্য দ্বারা ভূমির অবক্ষয় ও পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার নিয়েছে। একক প্রজাতির নিবিড় চাষে জীববৈচিত্র্য আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। মাটিতে নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান হ্রাস পেয়ে উৎপাদনক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাছাড়া কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের কুপ্রভাব পরিবেশের অন্যান্য জীব এমনকি মানবস্বাস্থ্যেও অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এতাছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি, সময়মত বৃষ্টিপাত না হওয়া, ঋতুবৈচিত্র্য ও তাপমাত্রার পরিবর্তন, কৃষিব্যবস্থাকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে এবং বাজারব্যবস্থার ত্রুটির ফলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ, অতিরিক্ত উপকরণ ও মাত্রাতিরিক্ত প্রযুক্তি-নির্ভরতা কৃষিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। তবে লাগসই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সঠিক নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে কৃষিকে আরও উৎপাদনশীল করা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য হুমকি মোকাবিলার মাধ্যমে দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খাদ্যাভ্যাসেও পরির্বতন আনা জরুরি। জাংক ফুড পরিহার করে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পরিমিত পরিমাণে মৌসুমি ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসচেতনতাও বাড়ানো জরুরি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য চাই জ্ঞাননির্ভর টেকসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং সথাসময়ে তা কৃষকের মধ্যে প্রয়োগ। প্রয়োজন দূরদর্শী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ যেন সমস্যাভিত্তিক ধারাবাহিক গবেষণায় কৃষিতে প্রযুক্তিগত ও জ্ঞানের নিরবিচ্ছিন্ন উন্নয়ন হয়। সুতরাং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও জোরদার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক