খাদ্য উৎপাদন বেশি, দাম এবং ভেজালও বেশি

10

সবুর শুভ

দেশে বর্তমানে খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদ হচ্ছে ১৫ কোটি ৪২ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ১৪ কোটি ১৮ লাখ, গমের মজুদ ১ কোটি ১৩ এবং ধান ১৮ লাখ মেট্রিক টন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমানে আমাদের মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে।
করোনার মধ্যে উৎপাদন বৃদ্ধিকে আশাব্যঞ্জক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এত উৎপাদনের মধ্যেও দেশে খাদ্যশস্য তথা নিত্যপণ্যের দাম সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। দামবৃদ্ধির ‘অস্বস্তির রথ’ কোনভাবেই থামছে না। প্রতিদিনই খাদ্যপণ্যের দামের সাথে যুক্ত হচ্ছে বাড়তি দাম। নিত্যপণ্যের বাজার যেন নিয়ন্ত্রণহীন। এছাড়া খাদ্যে ভেজাল ও মান নিয়ে জালিয়াতির ঘটনাও লাগামহীন।
এ অবস্থায় আজ শনিবার ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২১’। এ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দফায় দফায় বাড়তে থাকা ব্রয়লার মুরগির দাম গতকাল আরও বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে নগরীর বাজারগুলোতে কেজিতে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ১০/১৫ টাকা পর্যন্ত। এতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭০/১৭৫ টাকায়। তবে পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক কমানোর খবরে কমেছে পেঁয়াজের দাম। এতে কিছুটা স্বস্তি এসেছে পেঁয়াজে। একদিনে কেজিতে পেঁয়াজের দাম কমেছে ১০ টাকা। গতকাল শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে এসব জানা গেছে।
তথ্য মতে, গত সপ্তাহে প্রতি কেজি মুরগির দাম ছিল ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা। সোনালী মুরগির দাম বেড়ে এখন ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজি ৪০০ থেকে ৪২০ টাকায়।
এদিকে দেশের বৃহত্তম পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জ থেকে প্রাপ্ত অনুযায়ী, পাইকারিতে প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। যা একদিনে আগে বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকায়।
অন্যদিকে পাইকারিতে প্রতিকেজি মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকায়। যা একদিন আগে ছিল প্রতিকেজি ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। পাইকারীতে দাম কমলেও খুচরা বাজারে প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায় এবং মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৩ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের আড়তদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন জানান, সরকারের শুল্ক কমানোর ঘোষণার পর পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা কমানো হয়েছে। বর্তমানে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে। সংকটের কোন শঙ্কা নেই।
নিত্যপণ্যের মধ্যে তেলের বাজার বেশ অস্থির। খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে লিটার প্রতি ১৫০ টাকায়। সুপারের তেল বিক্রি হচ্ছে ১৪০ ও পামওয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৩৮ টাকা কেজিতে। বাজারে ৫ লিটারের সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে কোম্পানিভেদে ৬৯০/৭২৫ টাকা পর্যন্ত। ২০ দিন আগে ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ২৫/৩০ টাকা কম ছিল। ২০ দিন আগে খোলা তেলের দামও ৮/১০ টাকা কম ছিল।
চিনির দামও বাজারে বাড়তি।পাইকারি বাজারেই গতকাল চিনি বিক্রি হয় কেজি ৭৮ টাকা করে। তবে চালের পাইকারি বাজারে কেজিতে ২/৩ টাকা করে কমলেও খুচরা বাজারে তার প্রভাব এখনো পড়েনি।
সম্প্রতি চালের আমদানি শুল্ক কমানোর প্রভাবে দামের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে জানিয়ে পাহাড়তলী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির অর্থসম্পাদক আবদুল হাশেম বলেন, চালের বাজারে দাম কমতির দিকে। সামনে আরো কমবে। সরকার আমদানি শুল্ক কমানোর ফলে এটা হচ্ছে বলেও জানান এ ব্যবসায়ী নেতা।
এদিকে নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির সাথে সাথে ভেজালকারীরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ওজনে কম দেয়ার ঘটনা আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। মান জালিয়াতির এ ঘটনায় বিএসটিআই’র পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হলেও তা পর্যাপ্ত হচ্ছে না। ফলে থামছে না মান জালিয়াতির ঘটনাও।
এ বিষয়ে বিএসটিআই’র প্যানেল আইনজীবী এডভোকেট আশরাফ উদ্দিন খন্দকার জানান, ভেজাল বিরোধী অভিযান ও মান জালিয়াতির লাগাম টেনে ধরতে বিএসটিআই’র পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেক মামলাও হচ্ছে। কিন্তু এরপরও থামছে না ভেজাল ও জালিয়াতকারীরা। এক্ষেত্রে আইন আরো কঠোর করার উপর জোর দিয়েছেন এ আইনজীবী।
এদিকে ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ উপলক্ষে দেয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আমরা কৃষির উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়ে রূপকল্প-২০৪১-এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮, নিরাপদ খাদ্য আইন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-সহ উল্লেখযোগ্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। কৃষির উন্নয়নে আমরা কৃষকদের জন্য সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং কৃষি প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন, কৃষিঋণ, কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ, ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, ই-কৃষির প্রবর্তন, জলবায়ু ও ঝুঁকি সহনশীল ফসলের জাত-প্রযুক্তি উদ্ভাবন ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছি। কৃষি শিক্ষা-গবেষণা খাতে আরও বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছি। যার ধারাবাহিকতায় খোরপোশের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশব্যাপী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে কৃষিনির্ভর শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ ও আধুনিক দেশ হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবো।
তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে ১৬ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যার জন্য প্রতিদিন প্রতিজনের ৫০৯ গ্রাম হিসাবে বছরে তিন কোটি ছয় লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন খাদশস্যের চাহিদা রয়েছে। মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে আবারও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার। আর একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ দশমিক ৪৪৪ ডলার। ফলে এনিয়ে পরপর দুই বছর ভারতকে পেছনে ফেলল বাংলাদেশ।
অন্যদিকে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২১-এ ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। সূচকে মোট ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ১৯ দশমিক ১। সূচকে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৫তম। ২০১৯ সালে ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮তম এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৬তম।
গত বৃহস্পতিবার বিশ্ব ক্ষুধা সূচক (জিএইচআই) ২০২১ প্রকাশিত হয়। কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ও ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে যৌথভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সূচক অনুযায়ী, প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ১০১তম, স্কোর ২৭ দশমিক ৫। ২০২০ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ৯৪তম। এবারের সূচকে ৯২তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান, স্কোর ২৪ দশমিক ৭। গত বছর পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ৮৮তম।
ভোগ্য পণ্যের দামবৃদ্ধির বিষয়ে ক্যাব চট্টগ্রামের সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন জানান, বাজারে নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চাল। এ চালের দাম দীর্ঘদিন ধরে বাড়তি রয়েছে। তেল চিনির দামেও রয়েছে ক্রেতা সাধারণের চরম অস্বস্তি। সরকারি নজরদারির অভাব ও ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার মানসিকতা বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে প্রতি মুহুর্তে। বাজারের নিয়ন্ত্রণ এখন সম্পূর্ণ ব্যবসায়ীদের হাতেই, এটা কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক।