খাদ্যে ভেজাল এক ধরনের দুর্নীতি

95

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে মানুষের প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। মানুষের জীবন ধারনের জন্য খাদ্যের কোন বিকল্প নেই। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। এক কথায় ভেজালমুক্ত খাদ্য, সুস্থ্য জীবন।
আমরা জানি, যে খাদ্য ক্ষতিকর নয় যা দেহের ক্ষয়রোধ ও বৃদ্ধি সাধন করে বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধ করে এক কথায় তা হচ্ছে স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্য। অন্যদিকে যে খাবার বা খাদ্য মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর তা হচ্ছে ভেজাল খাদ্য। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছু যেন ভেজালের আবরণে ঢাকা। জীবন রক্ষাকারী ঔষধ, কোমলমতি শিশুদের খাদ্যও আজ ভেজালে সয়লাব। অধিক মুনাফার লোভে বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই এইসব কর্মকান্ডে জড়িত। বর্তমানে খাদ্যে ভেজালের মাএা এত বেশী যার ফলে এইদেশে বাস করা অনিরাপদ হয়ে ওঠছে। একই কথা সম্প্রতি বাংলাদেশের উচ্চতর আদালত বলেছে। এইক্ষেত্রে যে বা যারা এইসব কর্মকান্ডে জড়িত তাদের শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদন্ড সচেতন মহলে সে দাবি উঠেছে।
আমরা যে সব খাবার খাই এবং যারা উৎপাদনের সাথে জড়িত তারা বাড়তি উৎপাদন ও মুনাফা করতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে তাতে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তবে গুনগত মান নষ্ট হয়েছে প্রাণ বৈচিত্র হারিয়ে গেছে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী স¤প্রতি যে ৬৩৬০ পণ্যের সংগৃহীত নমুনার মধ্যে ৩১.১০ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল পাওয়া গেছে। গবেষক পাভেল পার্থ বলেন উৎপাদনকারীকে অধিক ফলনে যেন বাধ্য করা হচ্ছে কীটনাশক ব্যবহারে ফলে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরী করছে। অন্য দিকে উৎস স্থান, পরিবহন ও গুদামজাত করণে খাদ্যে রাসায়নিক মিশ্রণ তথা ভেজাল মেশানো হচ্ছে। পোল্টি শিল্পে খাবার হিসাবে যা ব্যবহার হয় মূলত বিষাক্ত পরবর্তীতে তাদের বর্জ্য মাছের খাবার হিসাবে ব্যবহার হয় ফলে অন্যদের কে আমরা অনিরাপদ করে তুলছি। বর্তমানে পরিবেশ যে ভাবে দূষিত হচ্ছে সেই খাদ্য অনিরাপদ ও ভেজালে সয়লাব হচ্ছে। প্রকৃত বাজার ব্যবস্থা নজরদারি করলে ভেজাল মুক্ত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত সম্ভব নয়।
আমরা জানি বিক্রয় বা বাণিজ্যিক উদ্দশ্য ব্যতীত পণ্যের মূল্য পরিশোধ বা বাকিতে পণ্য বা সেবা যারা ক্রয় করে তারা ভোক্তা। একজন ভোক্তার জাতিসংঘ স্বীকৃত ৮ টি অধিকার রয়েছে। যেমন- মৌলিক চাহিদা,তথ্য,নিরাপদ খাদ্য, পছন্দ, জানা, অভিযোগ প্রতিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান, সুস্থ পরিবেশ। অন্যদিকে এই সবের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করা, নিরাপদ খাদ্য বা সেবা নিশ্চিত করা। সেবা বা পণ্য ক্রয়ে প্রতারণা রোধ করা। অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। যা বাস্তবায়নে বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও প্রত্যেক জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ক্ষমতা প্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ পালন করেন। ৬ এপ্রিল ২০০৯ বাংলাদেশ সরকার ভোক্তা সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেন। এতে জাতীয় ভেজাল প্রতিরোধ ফাউন্ডেশান বাংলাদেশে ভেজাল প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।জাতীয় ভেজাল প্রতিরোধ ফাউন্ডেশানের কোন সদস্য বা কোন ভোক্তা তার পুণাঙ্গ তথ্য সহ কারন উদ্ভব হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে যে কোন পণ্যের উৎপাদনকারী, সরবরাহকারী, পাইকারী, খুচরা বিক্রেতার বিরুদ্ধে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রবাবরে লিখিত অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণিত ও জরিমানা করা হলে আদায়কৃত জরিমানার ২৫% অভিযোগকারী বা ভোক্তাকে প্রদান করা হবে মর্মে আইন প্রনীত হয়। একজন ভোক্তা বা অভিযোগকারী নিম্নলিখিত ব্যতায় হলে অভিযোগ করতে পারবেন। যদি….
১. পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা (১ বছর কারাদন্ড, ৫০০০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড)
২. মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা (১ বছর কারাদন্ড বা ৫০,০০০ টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ড)
৩. ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রয় (১ বছর কারাদন্ড বা ৫০,০০০ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড)
৪. ভেজাল পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় (৩ বছর কারাদন্ড বা ২ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড)
৫. ওজনে /পরিমাপে কারচুপি /বাটখারা পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি ( ১ বছর কারাদন্ড বা ৫০০০০ হাজার টাকা বা উভয় দন্ড) মেয়াদ উত্তীর্ন পণ্য বা ঔষধ (১ বছর কারাদন্ড বা ৫০,০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড)
৬. পণ্যের নকল প্রস্তুত বা উৎপাদন ( ৩ বছর কারাদন্ড ২ লক্ষ টাকা বা উভয় দন্ড)
৭. খাদ্য দ্রব্যে নিষিদ্ব দ্রব্যের মিশ্রণ ( ৩ বছর কারাদন্ড বা ২ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড)
৮. মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রতারনা (১ বছর কারাদÐ বা ২ লক্ষ টাকা অর্থদÐ বা উভয় দÐ)
তাহা ছাড়া আদালত মনে করলে দÐের অতিরিক্ত সংশ্লিষ্ট অবৈধ পণ্য বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। একই অপরাধে দÐিত ব্যক্তি পুনরায় একই অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণ করার বিধান রয়েছে। এই দিকে জাতীয় ভেজাল প্রতিরোধ ফাউন্ডেশান দেশের আপামর জনসাধারণকে ভেজালের অভিশাপ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। বর্তমানে সংস্থাটি সাধারণ মানুষের বা ভোক্তাদের অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করছে। অসাধু ব্যবসায়িরা ভেজাল খাদ্যের যে রাজত্ব বিস্তার করছে যার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নানাবিধ রোগ তথা ক্যান্সারের আশংকা বাড়ছে। ভেজাল বর্তমানে বাংলাদেশে আতঙ্ক কারণ এমন কোন পণ্য বা খাদ্য নেই যা ভেজাল বা রাসায়নিক মুক্ত। ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যের থাবা থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে হলে জাতীয় ভেজাল প্রতিরোধ ফাউন্ডেশানের একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। এই দেশের সকল নাগরিককে সচেতন হতে হবে। সকলের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় ভেজাল মুক্ত খাবার নিশ্চিত করা জরুরী।
আমরা মধ্যম আয়ের দেশে সত্যিকার অর্থে উপনীত হতে হলে ও খাদ্যে নিরাপত্তা সহ সকলকে ভেজাল মুক্তে সোচ্চার হতে হবে ও জনসচেতনতা সৃষ্টি জরুরী। আসুন ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করি ভেজাল ও খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে দেশকে মুক্ত করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক