খাদ্যে বৈচিত্রের বাংলাদেশ

42

মুশফিক হোসাইন

বাঙালিরা নিজেদের খাদ্যরসিক ও ভোজন বিলাসী ইত্যাদি বিশেষণে ভাবতে ভালোবাসে। আদিকাল হতে বাঙালি মাছে ভাতে বাঙালি হিসাবে পরিচিত। অথচ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ও শ্রেষ্ঠ এবং মঙ্গল কাব্যধারার শেষ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের ঈশ্বরী পাটনী কামনা করেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। এই কাব্যের সূত্রে বলা যেতে পারে বাংলায় গোয়ালভরা গরুও ছিল; পুকুর ভরা মাছও ছিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘খাবারের সেরা বস হলো রসনায়’। বসুই ঘরের এই রস যোগাড় করতে পরিবার প্রধানকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হত। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে প্রায় সতের কোটি মানুষ। এই জনসংখ্যা মানুষের নালে ঝোলে অম্বলে দিন গুজার করতে কষ্ট হচ্ছে বৈকি? ভোজন সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে রসনা তৃপ্ত করা কঠিন হয়ে উঠেছে। আমজনতার কাছে মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়ার লাগাম চেপে ধরার কোন মন্ত্র জানা নেই। তারপরও বাঙালির মধ্যে সংস্কৃতির কোন কমতি নেই। রস আস্বাদন হোক বা না হোক বাংলাদেশে খাদ্য বৈচিত্র্যতার অভাব নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে সকল খাদ্য কিন্তু আহার্য নয়:-কবি সুকান্ত ভট্টাচায্যের বিখ্যাত কবিতা ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। ক্ষুধার অনুভূতি তীব্র ও প্রচÐ। দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে মানুষের দৃষ্টি ও হৃদয় থেকে রূপরস সৌন্দর্য ও প্রেমের নান্দনিক বোধগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। তাই ক্ষুধার নিবৃত্তি অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে খাদ্য সংস্কৃতি ও খাদ্যদর্শন যা আছে; তা তাদের অস্তিত্বের সমরূপ। এ সংস্কৃতি ও দর্শনের সাথে নৃত্যত্তিক অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। যা সেই সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থা, লোকাচার, ধর্মকর্ম ও ঐতিহ্যের অংশও বটে। ‘খাবার তাই সম্পূর্ণ আহার্য নয়, ক্ষমতারও হিসাব নিকাশ। খানাখাদ্যের নিজস্ব ভৌগলিক অবস্থা আছে। উত্তর বঙ্গ, দক্ষিণ বঙ্গ আবার জেলায় জেলায় তার ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ইত্যাদি জেলার মানুষের মধ্যে খাদ্য সংস্কৃতি ও রসবোধ ভিন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশের খাদ্য সংস্কৃতির আলোকপাত করার সময় রাজনৈতিক দিক আলোচনার বহিভূত থাকবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্যরুচির হালকা চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করবো। বিশদ লিখতে গেলে গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করতে হবে। প্রথমেই আসা যাক চাটগাঁইয়া মেজবানী প্রসঙ্গে। মেজবান প্রধান, মৃত্যুবার্ষিকী কেন্দ্র করে চালু হলে বর্তমানে খতনা, জন্মমৃত্যু, রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে মেজবানী অনুষ্ঠান হচ্ছে। কর্পোরেট কালচারে এখন খাদ্যের দোকানে তা মিলছে। চাটগাঁইয়াদের শুটকীপ্রীতির কথা কিংবদন্তী। এছাড়া খাইস্যা, টক ক্বাজি, মধুভাত উল্লেখযোগ্য। চায়ে পরোটা বা বেলা বিস্কুট ডুবিয়ে বা চুবিয়ে যদি কেউ খেতে দেখেন-নিঃসন্দেহে তিনি চাটগাঁইয়া। সিলেটের প্রসিদ্ধ সাতকরা দিয়ে মাংস রান্না অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এছাড়া, হাওরের শোল, টাকি ইত্যাদি মাছের পোনার তরকারী যেমন স্বীকৃত তেমনি লেবু, আমড়ার মুকুল ইত্যাদি দিয়ে টক রান্নার স্বাদই আলাদা। তারা সজিনার ফল শুধু নয় পাতা, ফুল, মূল ভর্তাও পছন্দ করে থাকেন। উত্তর বঙ্গে ধনে পাতা দিয়ে আলুর পাতলা ডালে পরোটা খাওয়াতে অভ্যস্ত উত্তর বঙ্গের মানুষ। নারকেলের দুধে পোলাও আর চিংড়ির স্বাদ দক্ষিণের কৌলিন্য। বেগুন কিংবা নিজলা মরিচের ভর্তা মেঘে মাষকলাইয়ের রুটির স্বাদ পাবেন রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জে। চাঁপা শুটকির স্বাদ পাবেন হাওর ও ভাটি অঞ্চলে-তথা বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহে। বাকের খানি আর মোগলাই খাবারের জন্য ঢাকার মানুষের জুড়ি নেই। পাঁচ পদের শাক দিয়ে রান্নার জুড়ি নেই। ধামরাই, রংপুরের মানুষের জন্য রেখে দেয়া যেতে পারে। শিদল শুটকী পাড়াড়ি অঞ্চলে বসে নাপ্পি হয়ে ঘ্রান ছড়ায়। রংপুর ও দিনাজপুরে সবজিতে খাবারের সোডা দিয়ে রান্না অন্য অঞ্চলে বিরল। উত্তর বঙ্গের খাদ্য সংস্কৃতি কোচ-রাজবংশী সংস্কৃতিরই অবদান। ভাত ডাল মাছ বাঙালির প্রধান খাবার হলেও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যে প্রতিটি অঞ্চলের খাবারকে করেছে বৈশিষ্ট্যমÐিত। তবে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে, বাংলাদেশের প্রায় সখল অঞ্চলে টক রান্না প্রচলন আছে। কেউ টকবেগুন, কেউ তেঁতুল, অড়বড়ই, বেলেম্বু, শুষনিশাক, তেঁতুল পাতা, সাতকরা, লেবু আমড়ার মুকুল, আম, বড়ই ইত্যাদি দিয়ে। চান্দি ফাটা গরমে বিশেষ করে গ্রীষ্মে এই টক রান্না শিল্পের পর্যায়ে চলে গেছে। যা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত। পনের শতকের পুঁথি ও কাব্যে কবিগান খাদ্য সংস্কৃতির বর্ণনা দিয়ে গেছেন। পদ্ম পুরানে কবি বিজয় গুপ্ত যে সকল খাদ্য ও রন্ধনপ্রনালির কথা লিখে গেছেন—এই একুশ শতকেও দক্ষিণাঞ্চলের খাবারের কৌলিন্য বহন করে চলছে মহাসমারোহে। বিখ্যাত লেখক তপন রায় চৌধুরী চট্টগ্রাম ঞ্চলের প্রচÐ ঝাল সহযোগে শুটকী খাওয়ার জন্য বারবার জন্মাতে চেয়েছেন পৃথিবীতে। কাঁচা মরিচের প্রচÐ ঝালের সঙ্গে গলে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে অক্ষত থাকা রসুনের কোয়া, গলে যাওয়া পেঁয়াজের প্রায় অদৃশ্য উপস্থিতিতে লইট্যা মাছ বা লইট্যা শুটকীর ভুনার যে স্বর্গীয় স্বাদ অন্য কোথাও আছে কিনা প্রশ্ন সাপেক্ষ। মেজবানির গোমাংসের অপার্থিক স্বাদ চাটগাঁর চাইগাঁর পুণ্যভূমি ছাড়া অন্য কোথাও কি পাওয়া যাবে। যশোর খুলনার চুইঝালের গরু মাংস তার ধারে কাছেও নেই। পদ্মার ইলিশ তুলনাহীন। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় আছে রন্ধন শিল্পের মহার্ঘ। যা বাংলাদেশকে বিশ্বের খাদ্য সংস্কৃতির ব্রান্ড হিসাবে বিখ্যাত করতে পারে। খানাখাদ্যের ভুগোল অতিক্রম করে বিশ্ব দরবারে তাদের পরিচিত করার দায়িত্ব বাঙালিদের।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)