খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা পরিষদ

68

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রথম নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পায় ১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পাঁচ বছর শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। এরপর ৩০ বছর কেটে গেছে। তিন দশক ধরে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান তিন পার্বত্য জেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। যার ফলে জেলা পরিষদগুলো দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না জনগণ।
গত ১৬ ও ১৭ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল খাগড়াছড়ি সফরে ও রাঙামাটি জেলায় বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভায় অংশ নেন। এসব সভায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী এবং রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমাসহ একাধিক শীর্ষ রাজনীতিবিদ উপস্থিত ছিলেন। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ উন্নয়ন কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে তিন জেলা পরিষদে নির্বাচনের দাবি জানান।
এর আগে, চলতি বছরের ৮ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভা থেকে আঞ্চলিক পরিষদসহ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে নির্বাচনের জন্য সুপারিশ করা হয়। খবর বাংলা টিব্রিউনের
পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর গঠিত হয় আঞ্চলিক পরিষদ। ১৯৯৮ সালের ২৪ মে কার্যকর হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন অনুযায়ী ২৫ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচিত পরিষদ থাকার কথা। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমাকে চেয়ারম্যান করে পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। সেই থেকে গত ২১ বছরেও নির্বাচিত পরিষদ পায়নি আঞ্চলিক পরিষদ।
অন্যদিকে, ১৯৮৯ সালে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে প্রথমবারের মতো নির্বাচন হয়েছিল। নির্বাচিত পরিষদের হাত ধরে পাঁচ বছর উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৩ সালে প্রথম নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ শেষে সরকার পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ দিয়ে জেলা পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। সেই থেকে গত ২৫ বছর জেলা পরিষদগুলোতে আর কোনও নির্বাচন হয়নি। এত বছর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর চিত্র একই হলেও একটি পরিবর্তন হয়েছে, আর তা হচ্ছে ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ সরকার পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ ভেঙে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সেই ১৫ সদস্য বিশিষ্ট সদস্য দিয়ে চলছে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর কার্যক্রম।
খাগড়াছড়ি আসনের সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, ‘প্রত্যেক জেলা পরিষদে একজন পাহাড়ি চেয়ারম্যানসহ ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচিত পরিষদ থাকার কথা। কিন্তু নানা জটিলতায় গত আড়াই দশকেও নির্বাচন হয়নি। ফলে বিভিন্ন সরকারের আমলে মনোনীত সদস্যের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার ইতোমধ্যে ২৮-৩২টি সরকারি বিভাগ জেলা পরিষদের হাতে ন্যস্ত করেছে। কিন্তু অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ থাকায় বিভাগগুলোতে পর্যাপ্ত তদারকি হয় না। মুখ থুবড়ে পড়েছে উন্নয়ন কার্যক্রম। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বেড়েছে। এসব স্থবিরতা দূর করতে আমরা পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোতে নির্বাচনের দাবি করছি। প্রচলিত ভোটার তালিকা অনুযায়ী জেলা পরিষদের নির্বাচন হলে পর্যায়ক্রমে আঞ্চলিক পরিষদেও নির্বাচন হবে। পাহাড়ের উন্নয়ন, শান্তি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে নির্বাচিত পরিষদ দরকার।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটি কীভাবে নির্বাচনের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করল, তা বোধগম্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভূমিবিরোধ সমস্যাসহ অনেক কিছুরই এখন পর্যন্ত সমাধান হয়নি। এগুলোর সমাধান না করে নির্বাচনের জন্য সুপারিশ নীতিগতভাবে সমর্থন করা যায় না। চুক্তির শর্তানুযায়ী যদি জেলা পরিষদ নির্বাচনে পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দারা ভোট দেন, তাহলে নির্বাচন নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। আর জেলা পরিষদগুলোতে নির্বাচন হলে, আঞ্চলিক পরিষদেও নির্বাচন হবে।’ এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভাকেও তিনি চুক্তির লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, ‘দেশের প্রচলিত ভোটার তালিকা অনুযায়ী জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই, কারণ ২২ বছর আগে চুক্তি লিখিতভাবে করা হয়েছে।’
খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভুঁইয়া বলেন, ‘জেলা পরিষদগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে সব নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত রাখতে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। দুর্নীতি, আত্তীকরণ ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, সদস্য এবং কর্মচারীরা শতশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে ওয়াদুদ ভুঁইয়া বলেন, ‘আঞ্চলিক পরিষদে রাজতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। যিনি বাংলাদেশের ভোটার ও নাগরিক নন, তাকে চেয়ারম্যান করে সরকারি গাড়ি-বাড়ি-টাকা দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার।’
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সমীরণ দেওয়ান বলেন, ‘স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সুশাসন নিশ্চিত করতে জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকা দরকার।’
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, ‘আমি সবসময় নির্বাচনের পক্ষে। নির্বাচন হলে পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়নের সুতিকাগার বলে পরিচিত জেলা পরিষদগুলো আরও বেশি সক্রিয় হবে। ফ্যাক্সের মাধ্যমে নিয়োগপত্র আসবে না বা অপসারণ প্রক্রিয়াও থাকবে না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে জনসেবার সুযোগ পাবে। কাউকে খুশি-অখুশির কিছু থাকবে না। উন্নয়ন স্থায়ী হবে, শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে।’
এ বিষয়ে একাধিক ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।