খাগড়াছড়ির গুঁইমারায় বালু উত্তোলন থামছে না

65

খাগড়াছড়ির গুঁইমারা উপজেলায় অবৈধভাবে সর্বত্র চলছে বালু উত্তোলন। উপজেলায় কোনো বালু মহাল না থাকলেও ব্যাঙের ছাতার মতো বিভিন্ন স্থান থেকে বেপরোয়াভাবে স্ক্যাভেটর দিয়ে লক্ষ লক্ষ ফুট বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে প্রভাবশালী একাধিক চক্র। প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলনের ফলে ভেঙ্গে যাচ্ছে উপজেলার বিভিন্ন রাস্তাঘাট, ধসে যাচ্ছে ব্রিজ-কালভার্টের সংযোগ সড়ক, হুমকির মুখে সরকারি-বেসরকারিসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এসব যেন দেখার কেই নেই।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, বালু খেকোরা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে খালের পাড় কেটে অবাধে বালু হিসেবে বিক্রি করছে। উপজেলার তৈর্কমাপাড়া, চাইন্দামুনি, চিংগুলিপাড়া, বাইল্যাছড়ি ও সিন্দুকছড়িসহ প্রায় ১৬টি স্থান থেকে বালু উত্তোলন করছে তারা। আবার স্ক্যাভেটর দিয়ে কেউ কেউ কাটছে পাহাড়ি ছড়ার পাড়, কেউবা আবার খাল থেকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ড্রেজার মেশিন দিয়ে বিরামহীনভাবে বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। এ যেন হরি লুটের রাজত্ব চলছে।
গুঁইমারা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের মধ্যে হাফছড়ি ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটার দৃশ্য চোখে পড়েছে। মোট ১৮টি স্ক্যাভেটর দিয়ে কেটে ৩২টি ড্রাম ট্রাক ও ২০টি ট্রলিতে পরিবহন করছে এসব বালু ও মাটি। একদিকে শত শত একর ফসলি জমি নষ্ট করে ঊর্বর মাটি বিক্রি করা হলেও এসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই কৃষি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কারোরই। অন্যদিকে বালু উত্তোলন করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ কৃষকেরা। যার কারণে বর্ষা মৌসুমে ধ্বসে যাচ্ছে তাদের ফসলী জমি। অনেকগুলো ছোট খাল ও ছড়ার অস্তিত্ব ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।
সচেতন মহলের মতে, শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তি বিশেষ ও গোষ্ঠির অর্থ লালসার কারণে ধ্বংস হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকায় ব্যয়ে নির্মিত ব্রিজ-কালভার্টসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প। পাশাপাশি স্থাধারণ মানুষ হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত। জনস্বার্থে এখনই তাদের এসব কর্মকান্ড প্রতিরোধ করা না গেলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কঠিন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
হাফছড়ি এলাকার ক্যাজরি মারমা জানান, অবৈধ বালু খেকোরা ধরাকে সরাজ্ঞান মনে করে চলছে। এ ব্যবসায় বাঁধা বলে কোনো শব্দ নেই, যা আছে তা হচ্ছে আয় আর আয়। এতে করে অনেকেই রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে বটগাছও বনে গেছেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ আর সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রম।
স্থানীয় কৃষক ন্যাপা মার্মা ও অংগ্যজাই মার্মা জানান, বালু খেকোদের এমন আগ্রাসীকান্ডে এলাকার ফসলী জমি ধ্বংসের মুখে। তারা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। গড়ে উঠেছে প্রভাবশালীদের নিয়ে বালু ব্যবসার বড় ও শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যে কারণে গণমাধ্যমকর্মীরাও সংবাদ প্রকাশে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। এছাড়াও বালুবাহী ট্রাকের অবাধে যাতায়াতের কারণে ধুলোবালিজনিত নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ।
স্থানীয় রাপ্রূ মারমা জানান, আমার পরিবার বালু ব্যবসায়ী মেহেদুল মাঝি’র কাছে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকায় আমার বসতঘর সংলগ্ন খালের পাড় বিক্রি করেছেন। তবে আমার জায়গা থেকে বালু তোলার মৌখিক অনুমতি দিয়ে বিপদে পড়েছি। কারণ ওই মেহেদুল মাঝি আমার সম্পূর্ণ টাকা এখনো দেয়নি। এ নিয়ে পারিবারিকভাবে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।
একাধিক বালু ব্যবসায়ী জানান, ‘আমাদের কাছে বালু উত্তোলনের বা খালের পাড় কেটে বিক্রির বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই’। অবৈধ জেনেও এ ব্যবসা কিভাবে করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, বিভিন্ন উপায়ে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের এ ব্যবসা। টাকা দিলে অনেক কিছুই করা সম্ভব।
তৈর্কমা এলাকার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা অংক্যচিং চৌধুরী জানান, বালু উত্তোলন ও খালের পাড় কেটে বিক্রি করায় কৃষকদের ফসলী জমি ক্ষতির মুখে। বিষয়টি তিনি অবগত হয়ে উপজেলার সাপ্তাহিক মিটিংয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।
হাফছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান চাইথোয়াই চৌধুরী জানান, বালু উত্তোলন ও খালের পাড় কেটে বিক্রির বিষয়গুলো বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি শুনেছেন। তবে ব্যস্ততার কারণে সরেজমিনে গিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি তার।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক ফেরদাউস আনোয়ার জানান, গুঁইমারায় অবৈধ বালু উত্তোলন ও খালের পাড় কেটে বিক্রির বিষয়টি তারা অবগত হয়েছেন। লোকবল সংকটের কারণে খাগড়াছড়িতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তবে গুঁইমারায় বালু উত্তোলনের বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর বিধি সম্মতভাবে দেখবে।
এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার তুষার আহমেদ জানান, বালু উত্তোলন ও খালের পাড় কেটে বিক্রির বিষয়ে দ্রুততম সময়ে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এর ১৫ (১)- এই আইনের ধারা ৪ এ বলা হয়েছে, অনুমতি ব্যতিরেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করিলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী ব্যক্তিবর্গ (এক্সিকিউটিভ বডি) বা তাহাদের সহায়তাকারী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ অনূর্ধ্ব ২(দুই) বৎসর কারা্নড বা সর্বনিম্ন ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা হইতে ১০ (দশ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।