খতীবে বাঙাল অধ্যক্ষ জালাল উদ্দীন আল কাদেরীর স্মরণে

13

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

মানুষকে মহান আল্লাহ পাক ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে জান্নাত। এই জান্নাতও সৃষ্টি। এই জান্নাতের চেয়ে মানুষ বড় যদি আমরা ইনসানই কামিল হই। যদি প্রকৃত মানুষ হতে না পারি তাহলে জাহান্নামের চেয়ে অধম। জাহান্নামের জ¦ালানি। ইনসানে কামিল হওয়া সহজ নয়, কঠিন। ইনসানে কামিলের গোলামী করে ‘জান্নাত’। আমার দৃষ্টিতে খতীবে বাঙাল উস্তজুল উলমা আল্লামা জালাল উদ্দীন আল কাদেরী(রাহ.) ছিলেন একজন ইনসানে কামিল।
রাজ্য জয় করা সহজ কিন্তু মানুষের হৃদয় জয় করা কঠিন। আল্লামা জালাল উদ্দীন আল কাদেরী(রাহ.) অসংখ্য সৃজনশীল কর্ম, সুন্নীয়তের খেদমতে জীবন উৎসর্গ করে যেভাবে মানুষের হৃদয় জয় করেছে তার প্রমাণ ঢাকা-চট্টগ্রামের কয়েকটি নামাজে জানাজায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল। নামাজে জানাজায় কী অপূর্ব দৃশ্য, অসাধারণ আবেগ-কান্না তা না দেখলে কল্পনা করা যেত না।
প্রচারে পণ্যের প্রসার ঘটে, বিদ্যার নয়। তিনি তা জানতেন এবং বুঝতেন বলেই তিনি নীরবে নিভৃতে জ্ঞান চর্চা করেছেন এবং দেশের হাজার হাজার আলেম, ফকিহ, মুহাদ্দিস, মুদাচ্ছির, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, চিকিৎসক ও সরকারি কর্মকর্তার শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠান ও কৃতীমান ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন মহাপ্রলয়ের শেষ রজনী পর্যন্ত। কারণ মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘উজকুরু মাহাসিনা মাউতাকুম’ ‘তোমরা মৃত ব্যক্তির মহৎগুণগুলো স্মরণ কর। মৃত্যুর পর মানুষের অসৎ দিকগুলো আলোচনা না করে সৎগুণগুলোর আলোচনা করতে হাদিসের নির্দেশ।
মাওলানা জালাল উদ্দীন আল কাদেরী আমাদের বহুদিকে ঋণী করে গেছেন। যে ঋণ শোধ করা যাবে না কোনদিন। যে ঋণ আমাদের নত করেনি বড় করেছেন, দরিদ্র্য করেনি ধনী করেছেন।
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যিনি মহামানবতার সেবায় নিজের জীবনকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেন তিনিই মহামানব’।
আজ মহামানব নয়, একজন নেহায়েত সাধারণ ও স্বাভাবিক মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন, যে সমাজের বা মানুষের উপকার নয় অপকার করে না, সে ন্যায় কাজ নয় শুধু অন্যায় করে না, যে ভালোবাসা নয় ঘৃণা করে না। অধ্যক্ষ মাওলানা জালাল উদ্দীন আল কাদেরী(রাহ.)’র চরম শত্রæও বলতে পারবে না, তিনি জীবনে কোন মানুষের ক্ষতি করেছেন, নিন্দা করেছেন, অশ্রদ্ধা করেছেন।
তিনি আমাদের সুন্নীয়তের ইতিহাসের অধ্যায়, ইতিহাসের অংশ। ইন্তেকালের মধ্যদিয়ে স্মৃতিচারণ হয়, ইতিহাস হয় না, ইতিহাস হয় জীবন দিয়ে। তিনি সারা জীবন সুন্নীয়তের কাজে উৎসর্গ ছিলেন। মানুষের জীবনে সবচেয়ে দামী জিনিস, মানুষের ঈমান। তাঁর কর্মকাÐের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঈমান মজবুত করেছেন। তিনি সব সময় সত্যকে ধারণ করতেন। তিনি বলতেন, ‘সত্য কথা কে পছন্দ করলো কে করলো না সেদিকে না থাকি আল্লাহ তাঁকে পছন্দ করছেন কী না সে দিকে থাকাও’।
তিনি সারা জীবন আল্লাহ, রাসুল (দ.) ও অলিয়ে কেরামদের স্মরণ করেছেন, আমরা তাঁকে স্মরণ করছি, তাই তিনি স্মরণীয়। হযরতুল আল্লামা হাফেজ ক্বারী ছৈয়দ আহমদ ছিরকোটি (রা.) জামেয়া আহমদীয়া সুন্নীয়াকে ‘কিশতীয়ে নূহ’ আখ্যায়িত করেছিলেন। এই জ্ঞানের বাগনটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠে অত্যন্ত মেধাবী, সরল মনের অধিকারী, সজ্জন ব্যক্তিত্ব আল্লামা জালাল উদ্দীন আল কাদেরীর হাতে।
কি ভাবে মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, মানুষকে কিভাবে সম্মান করতে হয়, এই নিরহংকার ব্যক্তির কাছে শিখার আছে। আলেম সমাজ আরবী, উর্দু, ফার্সী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করলেও বাংলা ও ইংরেজী ভাষা ছিল দুর্বল। কিন্তু অধ্যক্ষ জালাল উদ্দীন আল কাদেরী কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়েও ভালো বাংলা ও ইংরেজী শুদ্ধ উচ্চারণে প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তাই তাঁর বক্তব্য প্রতিপক্ষের লোকজনও সহজে গ্রহণ করত। কোরআন হাদিসের দৃষ্টি কঠিন কথাকে সহজ করে বলার প্রজ্ঞার অধিকারি ছিলেন। সব মতের গ্রহণযোগ্য আলেম দিলেন তিনি। তাঁকে যে দায়িত্ব দেওয়া হতো তা তিনি সুচারুরূপে পালন করতেন। দীর্ঘদিন জামেয়ার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন কালে কোন দায়িত্বকে অবহেলা করেননি। এই প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নতি ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন জামেয়াকে বাংলাদেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন। তাঁর দুরদর্শিতা ও দক্ষতার কারণে ২০১১ ও ২০১৪ সালে জামেয়া শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং তিনি শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ’র স্বীকৃতি অর্জন করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রতিষ্ঠান গড়তে গড়তে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। তিনি আলোকিত মানুষ, আলো বিতরণ করতে করতে শেষনিঃশ^াস ত্যাগ করলেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, মান কানা ফি হাজেহী আম্মা, ফাহুয়া ফিল আখেরাতে আম্মা’। অর্থাৎ যে এই দুনিয়াতে অন্ধ সে পরকালেও অন্ধ থাকবে। জালাল উদ্দীন আল কাদেরী(রাহ.) ইহকালে অন্ধ ছিলেন না, আলোকিত ছিলেন তাই পরকালেও আলোকিত থাকবেন।
হযরত মাওলা আলী (রা.) বলেছেন, মূর্খ লোক জীবিত থাকতেও মৃত আর শিক্ষিত লোক মৃত্যুর পরও জীবিত। আল্লামা জালাল উদ্দীন আল কাদেরী শুধু শিক্ষিত ছিলেন না, আধ্যাত্মিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তাই তিনি আমাদের মাঝ হতে বিদায় নিলেও বেঁচে থাকবেন অন্তকাল।
ইংরেজ কবি সেক্সপিয়র বলেছেন, ‘ কোন কোন মানুষ একবার মরে, কোন কোন মানুষ দুইবার মরে’। মহামনীষীরা দেহগতভাবে মরলে স্মৃতি ও ইতিহাস হতে মরে না, আমরা সাধারণ মানুষ দেহগত ও মানব স্মৃতি হতে দুইবারই মরি।
আল্লামা জালাল উদ্দীন আল কাদেরী(রাহ.) দেহগত বিদায় হলেও ইতিহাসে অজয় অমর অক্ষয় অব্যয় হয়ে থাকবে। খতিবে বাঙাল মাওলানা জালাল উদ্দীন আল কাদেরী(রাহ.) কিছুদিন পূর্বে জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে এক নামাজে জানাজার পূর্বে এক মিনিটের বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমরা এক সময় ছিলাম না, এখন আছি, আমরা এক সময় থাকবো না, এই হলো আমাদের জীবন’। সে দিন বুঝতে পারিনি তিনি এত তাড়াতাড়ি নাই হয়ে যাবেন। গত শোহাদায়ে কারবালা মাহফিলে আমার আলোচনা শুনে মুগ্ধ হয়ে অভিবাদন জানিয়ে ছিলেন। সেদিন মনে মনে ভেবেছিলাম বড় বড় নামধারী আলেমকে দেখিনি আমার মত সাধারণ ব্যক্তিকে স্বীকৃতি দিয়ে উৎসাহিত করতে। তিনি সত্যিই মহৎ। আল্লাহ তাঁর বেহেস্ত নসিব করুন।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক