ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী খুমী সম্প্রদায়: একটি সমাজ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

18

শামসুদ্দীন শিশির

(গত সংখ্যার পর )
৬. পেশার রকম-সকম : অধিকাংশ খুমী জুম পেশার উপর নির্ভরশীল। খুব কম সংখ্যক খুমী সরকারি ও বেসরকারি চাকরি করছে। জুম চাষের সময় খুমীরা একে অপরের জুমে পালাক্রমে কাজ করে শ্রম বিনিময় করে। আবার কখনো কখনো পাড়ার যে কোন ঘর নির্মাণ করলে তখনো একে অপরকে সহযোগিতা করে শ্রম আদান-প্রদান করে থাকে। খুমী সমাজের লোকজনকে ভিন্ন পেশার তাগিদে নগরমুখী হতে এখনও দেখা যায়নি। জুম চাষে ফলজ গাছের প্রতি এরা বেশি আগ্রহী। তবে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের কলা চাষের প্রতিও তাদের আগ্রহ বেড়েছে। জুম চাষের মাধ্যমে ধান, মরিচ, কাঁকরোল, তামাকপাতা, হলুদ, আদা, শাক-সব্জি উৎপাদন করে।
৭. বসবাসের ধরণ : ঘর নির্মাণের জন্য খুমীরা বাঁশ, গাছ ও শন ব্যবহার করে। তারা মাটি থেকে ৩/৪ উঁচুতে মাচাং ঘর নির্মাণ করে। খুমীদের একক পরিবারে সাধারণত একটি রুম ও একটি চুলা থাকে। যৌথ পরিবারের ক্ষেত্রে ২/৩ টি রুম থাকে এবং প্রতিটি রুমে একটি করে চুলা থাকে। একটি খুমী ঘরে সাধারণ দুটি প্রবেশ পথ; ১/২ টি বাঁশের তৈরি উঠান এবং ২/৩ টি জানালা থাকে। মূল ঘরে প্রবেশ পথে উপরে দেওয়ালে টাঙ্গানো থাকে শিকারে পাওয়া বিভিন্ন জীব-জন্তুর মাথার খুলি, লেজ, পা, পালক ইত্যাদি। শিকারে পাওয়া জীব-জন্তুর এসব প্রতীক হচ্ছে গৃহকর্তার শিকারে দক্ষতার নিদর্শন।
৮. ধর্মীয় অবস্থা : খুমীরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃত পক্ষে তারা প্রকৃতি পূজারি। তবে তারা আজকাল তিনটি ধর্মে বিশ্বাসী প্রকৃতি পূজারি, ক্রামা ও খ্রিস্টান। প্রকৃতি পূজারি খুমীরা বিভিন্ন সময়ে গৃহপূজা, ছড়া পূজা, বৃক্ষ পূজা ও পাথর পূজা করে থাকে। খুমীদের বিশ্বাস পৃথিবী সৃষ্টির পেছনে একজন সর্বশক্তিমান দেবতা আছে তাকে খুমী ভাষা বলা হয় ‘তামিউ’। বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার বসবাসকারী খুমীদের কেউ কেউ ‘ক্রামা’ ধর্ম অনুসরণ করে। তবে রুমা ও থানচি উপজেলায় ‘ক্রামা’ ধর্মের অনুসারীরা নেই। এই দুই উপজেলার খুমীদের কেউ কেউ প্রকৃতি পূজারী, কেউ কেউ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।
খুমী সমাজে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা প্রায় ৪৫%, প্রকৃতি পূজারীদের সংখ্যা ৪৫% এবং ক্রামা ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা প্রায় ১০% ভাগ হবে বলে অনুমান করা হয়। প্রকৃতি পূজারীদের জন্য কোন উপাসনালয় না থাকলেও খ্রিস্ট ও ক্রামা ধর্মাবলম্বীদের জন্য গির্জা ও ক্যাং উপাসনালয় রয়েছে।
ক্রামা ধর্মাবলম্বীরা ‘ক্রামাদি বনবাস গমন’ উৎসব পালন করে। অন্যদিকে খ্রিস্ট ধর্মের বিশ্বাসী খুমীরা বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে এবং ঐ দিনে তারা সৃষ্টিকর্তার প্রশংসামূলক বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সংগীত পরিবেশন করে।১৬
৯. সামাজিক উৎসব : খুমী সমাজের প্রকৃতি পূজারিরা সাংগ্রাই (বিঝু) উৎসব উদ্যাপন করে; যদিও এরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মতো বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শ পালন করে না। সাংগ্রাই-এর দিনে কিছু কিছু প্রকৃতি পূজারী খুমীরা চাল, কাপড়, জুমে উৎপাদিত বিভিন্ন ফসল, টাকা ক্যাং উপাসনালয়ে দান করে। সাংগ্রাই উৎসবকে খুমী ভাষায় ‘সাংক্রাই’ বলে। খুমীরা সাধারণত তিন দিনই সাংক্রাই উৎসব পালন করে।
১ম দিন : খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঝুঁড়ি ভর্তি ধান, ভূট্টা নিয়ে প্রতিবেশীদের উঠানে ছিটিয়ে দেয় পশু-পাখিরা খাওয়ার জন্য। এ কাজটি মূলত পুরুষরাই করে। ভালোভাবে স্নান সম্পন্ন করে পরিপাটি হয়। মেয়েরা সুস্বাদু রান্না করে। মুরুব্বীদের প্রণাম করে। তারপর পরিবারের সবাই মিলে এক সঙ্গে বসে খায়। তারপর প্রতিবেশীদের সাথে আড্ডায় বসে।
২য় দিন : খুমী যুবক-যুবতীরা নানা রকম ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলার আয়োজন করে গিলার খেলা, বাঁশ খেলা ও পানির খেলা।
৩য় দিন : দল বেঁধে নদীতে মাছ ধরতে যায়। আবার অনেকে শিকারে বের হয়।
খুমীরা বছরে দুইবার নবান্ন উৎসব আয়োজন করে। প্রথম উৎসব জুন/জুলাই মাসে আয়োজন করা হয় জুমে ফসল বোনা উপলক্ষে। বছর শেষে জুমের ফসল কাটার সময়ও অনুরূপ উৎসবের আয়োজন করা হয়। নবান্ন উৎসবকে খুমী ভাষায় ‘ওয়াং ইয়া’ বলে। ‘ওয়াং ইয়া’- উৎসবে দুই দিন পাড়া বন্ধ থাকে। বন্ধের দিন পাড়াবাসীর পাড়ার বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।১৭
বাঁশ খেলাটি হয় সাধারণত পুরুষদের মধ্যে। এই খেলাকে খুমী ভাষায় বলা হয় ‘আথো আংকে’। ৪/৫ ফুট শক্ত লম্বা বাঁশের দুই প্রান্তে দু’জন দাঁড়িয়ে ব্যালের নিচে শক্ত করে আটকিয়ে রেখে ঠেলে এক পক্ষ প্রতি পক্ষকে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করে। যে মাটিতে প্রথমে পড়বে সে হেরে যায়। এই খেলায় গ্রামের যুবতীরা দর্শকের ভূমিকা পালন করে উৎসাহ দেয়। পানি খেলা হয় সাধারণত যুবক-যুবতীদের মধ্যে। তারা একটি ঘরে মিলিত হয়ে পাত্রে বা কলসিতে পানি ভরিয়ে একে অপরকে ভিজিয়ে দেয়। এছাড়াও রয়েছে ‘নিশাজা’ (শুষ্ক মৌসুম পাড়া বন্ধক পূজা), ‘নিচোজা’ (আষাঢ়ী পূজা), ‘লব’ (জুমে প্রথম আগাছা পরিষ্কার করার পূজা) এবং ‘চো প্ল’ (ধান কাটার সময় পূজা)। জুম ও পাড়া কেন্দ্রিক পূজা ছাড়াও খুমী সমাজে বেশ কয়েকটি সামাজিক অনুষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গো-হত্যা অনুষ্ঠান। গো-হত্যা অনুষ্ঠান দুই প্রকারের হয়ে থাকে। যথা-১ আরেং চেংনাই পই এবং ২-রেইংনাই পই। নিজেদের প্রথাগত সামাজিক উৎসবের পাসাপাশি খুমীরা রাজপুণ্যাহ্ অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করে। রাজপুণ্যাহ্র দিনে খুমী মুরব্বিরা তথা পাড়া কার্বারীরা এক বোতল মদ বা রাইসবিয়ার ও একটি মোরগ দিয়ে খাজনা প্রদান করে বোমাং চিফকে।
ভাষা ও বর্ণমালা : খুমীদের ভাষা তিব্বতি-বার্মিজ-কুকি চীনদল ভুক্ত একটি ভাষা। কুকি-চীন ভাষায় অভিজ্ঞ আমেরিকান ভাষাবিদ ড. ডেভিড এ পিটারসন মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বম, খিয়াং, পাংখোয়া ও লুসাই আদিবাসীদের ভাষাও কুকি-চীনদলভুক্ত ভিন্ন ভিন্ন ভাষা। এই আমেরিকান মনে করেন, অনেক ভাষাবিদ যদিও ম্রো ভাষাকে কুকি-চীন দলভুক্ত ভাষা বলে দাবি করেন; কিন্তু এই ভাষার বৈয়াকরণিক (ঝুহঃধী) আচরণে এটি কুকি-চীন পরিবারভুক্ত ভাষা বলে পুরোপুরি দাবি করা যায় না। কারণ এই ভাষার বৈয়াকরণিক আচরণ অন্যান্য কুকি-চীন পরিবার ভুক্ত ভাষা গুণের সাথে মিল নেই। খুমী, বম, খিয়াং লুসাই ও পাংখোয়া ভাষার সাধারণ বাক্য বিন্যাস হয় বিশেষ্য, অব্যয় ও ক্রিয়া আঙ্গিক; তথা ঝঁনলবপঃ, ঙনলবপঃ ্ ঠবৎন (ঝড়া)। যেমন- খুমী ভাষার কাই বিউ চা অর্থ হলো আমি ভাত খাই। এই বাক্যে ‘কাই’ অর্থ আমি, ‘বিউ’ অর্থ ভাত এবং ‘চা’ অর্থ খাই। অর্থাৎ বিশেষ্য, অব্যয় ও ক্রিয়া যথাক্রমে বসে।
অন্যান্য কুকি-চীনভাষাসহ বাংলা, চাক্মা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষাগুলোও একই বাক্য বিন্যাসের নিয়ম অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু ম্রো ভাষার বাক্য বিন্যাস ভিন্নরূপ। ম্রো ভাষায় বিশেষ্যের পরে ক্রিয়া এবং শেষে বসে অব্যয়। যেমন- ‘আংচা হম’ অর্থ হল আমি ভাত খাই। এই বাক্যে শব্দ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় ‘আং’ অর্থ আমি, ‘চা’ অর্থ খাই এবং ‘হম’ অর্থ ভাত।
তথা এই ভাষায় বাক্য বিন্যাসটি অন্যান্য কুকি-চীন ভাষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই অনেক কুকি-চীন ভাষাবিদদের মধ্যে ম্রো ভাষা আসলে কি কুকি-চীন পরিবার ভুক্ত কিনা তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ম্রোরো কে কুকি-চীন পরিবারভুক্ত কিনা তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ম্রোরা যে কুকি-চীন পরিবারের দল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
খুমী ভাষা হচ্ছে স্বরযুক্ত (ঞড়হধষ খধহমঁধমব) একটি ভাষা। এই ভাষায় প্রধানত ৩টি স্বর (ঞড়হব) রয়েছে। তবে এই ভাষায় বিভক্তি ভেদে ৯-১০টি ঞড়হব লক্ষ করা যায়। খুমীদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। তারা রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করে। খুমী ভাষায় বাইবেল এবং ধর্মীয় সংগীতের বইও রয়েছে। বার্মার চীন প্রদেশের খুমীরা দীর্ঘদিন ধরে এই বর্ণমালা চর্চা করলেও বাংলাদেশের খুমীরা তা স¤প্রতি চর্চা করছে। এই বর্ণমালা মূলত খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী খুমীরাই চর্চা করছে। খুমী ভাষার বর্ণমালা নিম্নে দেওয়া হলো- অ, ণ, ণঐ, অড, ই, ঈঐ, উ, ঊ, ঋ, ঐ, ও, ঔ, ক, খ, গ, ঘ, ঘএ, ঙ, চ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ত.
খুমী ভাষায় সর্বমোট ২৫টি বর্ণমালা রয়েছে। প্রথম চারটি অক্ষর এবং ষষ্ঠ অক্ষর ব্যতীত অন্যান্য অক্ষরগুলোর উচ্চারণ ইংরেজি বর্ণমালার উচ্চারণের সাথে মিল রয়েছে। খ্রিস্ট মিশনারীদের সহযোগিতায় নিজ ভাষার অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন খুমীরা অন্যান্য খুমী পাড়ায় গিয়ে অক্ষরজ্ঞান দান করছে। তবে বয়স্কদের তুলনায় অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরাই বেশি এই অক্ষরজ্ঞান নিতে আগ্রহী।
খুমী ভাষায় পশু-পাখির নাম : বাংলা খুমী, মুরগি আহ, হাঁস রংপাই , কবুতর বুহু, ঈগল আমু, পাখি তোও, ছাগল মেএ, গরু ছাড়া বা সি, মহিষ পাই নো, গয়েন স্তাং, হরিণ স্থী, শূকর এউ, সাপ প্ইুউই, বানর ক্লাই
জলজ প্রাণীর নাম : বাংলা খুমী, মাছ ঙো, চিংড়ী আছেং, কাঁকড়া তা আই, শামুক আতেং, কচ্ছপ উইকিই
খাদ্য শস্যের নাম : বাংলা খুমী, ধান চো , ভূট্টা মেক্তে, মরিচ শারমিং, তুলা প্লো, কলা কুইতি, পেঁপে সাপ্লা
জাতি সম্পর্কের নাম : বাংলা খুমী, মা আনেই, বাবা আই, জা আই, দাদা যায়, বোন তুইচো, ভাই আমপ্রো, মামা/শ্বশুর পু , মামি/শাশুড়ি পি, চাচা আইচে, দাদা/দাদি আতা
সংখ্যা গণনা : বাংলা খুমী, এক হা, দুই নি, তিন থুং, চার প্লি, পাঁচ পাং, ছয় ত্রিউ , সাত সিরি, আট তাজা, নয় তক, দশ হো, বিশ অপুং, ত্রিশ ফাই, চল্লিশ উইপ্লি, পঞ্চাশ উইপাং, ষাট উইত্রিউ, সত্তর উইসিরি, আশি উইতাজা, নব্বই উইতক, একশ চুং ঙাই, এক হাজার সাং, দশ হাজার সাং হো, এক লক্ষ তিসিং (চলবে)
লেখক : পিএইচডি গবেষক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জা.বি.