ক্ষণজন্মা চির স্মরণীয় মহান এক সাহাবী হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)

35

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের প্রিয় নবীর পর অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মাধুর্য ব্যবহার, ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠতা, অগাধ জ্ঞানের গভীরতা, কালজয়ী আদর্শিক একনিষ্ঠতা, কুরআন-সুন্নাহর নীতি-জ্ঞানে পরিপক্কতা, দায়িত্ব পালনে কর্তব্য-নিষ্ঠা, অমায়িক, সাবলীল, দৃঢ়, মিতব্যীয়, দানশীল, স্বাধীনচেতা ও মনোবলি ব্যক্তিত্ব, নিঃস্বার্থ প্রজা পালনে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী যত রাষ্ট্রনায়ক সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম যাঁর নামটি শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, তিনি হলেন ইসলামী খেলাফাতের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু।
তাঁর মধুময় ব্যবহার, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সচ্ছলতা, ব্যবসায়িক দক্ষতা, পরোপকার, বিশ্বস্ততা, সচ্চরিত্র, জ্ঞান, মেধা, বাগ্মিতা, কাব্য প্রতিভা ও পাÐিত্যের কারণে তিনি ছিলেন সকল মক্কাবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র। যিনি শুধু বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও জ্ঞানীই ছিলেন না, বরং সমগ্র জীবনে নিষ্ঠাবান ও সৎও ছিলেন।
তিনি এক সংকটময় মুহূর্তে ক্ষমতা গ্রহণ করে মুসলিম জাতির ত্রাণকর্তারূপে ইতিহাসে একজন ক্ষণজন্মা হিসেবে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। নবুয়্যতের প্রতি ঈর্ষান্বিত বেদুইনদের হিংসা, রোম-পারস্য আর অমুসলিমদের চক্রান্ত, ভÐ নবীদের প্রাদুর্ভাব, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও ধর্মদ্রোহী কার্যকলাপ, বহি:শত্রæর আক্রমন, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি ইসলাম ধর্ম এবং নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। এ সকল অশুভ চক্রান্ত ও বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে অনিবার্য ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করেন তিনি।
প্রিয় নবীর ইন্তিকালে সৃষ্ট সংকট সমাধান :
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকাল ছিল সাহাবায়ে কেরামের জীবনে চরম অনাকাক্সিক্ষত একটি ঘটনা। এ ঘটনার শোকে তাঁরা একেবারেই হতবিহŸল হয়ে পড়েন। কারণ, রাসুলের ইন্তেকাল হতে পারে বিষয়টি তাঁদের ভাবনাতেই ছিল না। হযরত ওমর রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু কোষমুক্ত তরবারি হাতে ঘোষণা করলেন, যে বলবে হযরতের ইন্তেকাল হয়েছে আমি তাকে হত্যা করব। হযরত আবু বকর এগিয়ে এসে স্থির চিত্তে ঘোষণা করলেন, “যারা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইবাদত করত তারা জেনে রাখো, তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করো তারা জেনে রাখো, আল্লাহ চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু নেই।” অতঃপর তিনি সুরা আল-ইমরানের ১৪৪ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করে শুনালেন,“হযরত মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল ছাড়া অন্য কেউ নন। তাঁর আগে বহু রাসুল অতীত হয়েছেন। তিনি যদি ইন্তেকাল করেন বা শহীদ হন তাহলে কি তোমরা পেছনে ফিরে যাবে? (আল-ইমরান- ১৪৪) আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্য শুনে সাহাবায়ে কেরাম হুশ ফিরে পেলেন এবং তাঁদের অবস্থা স্বাভাবিক হয়।
খলিফা নিযুক্ত :
নবীজির দাফন সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে পরবর্তী দায়িত্বশীল নিয়ে তথা খিলাফতকে কেন্দ্র করে মত-পার্থক্যের কারণে চরম রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলাম চরম হুমকির সম্মুখীন হয়। এ অবস্থায় হযরত আবু বকর তাঁর অসাধারণ মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ধীরস্থিরভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করে মত-পার্থক্য নিরসন করে অন্যান্য বিশিষ্ট সাহাবীদেরকে সাথে নিয়ে অচলাবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেন। সকলের সম্মতিতে তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী রাষ্ট্রকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন। এ রাজনৈতিক জটিলতার উপযুক্ত সমাধান করে তিনি যে নজির সৃষ্টি করেছেন তা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
হযরত ওসামা বিন যায়দ রদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু’র নেতৃত্বে যুদ্ধ বাহিনী প্রেরণ :
নবীজি তাঁর ওফাতের পূর্বে হযরত ওসামা’র নেতৃত্বে সিরিয়ার সীমান্তে একটি অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে এ অভিযান স্থগিত রাখা হয়। এ দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের সংবাদে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন দিকে নানা অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। কেউবা ইসলাম ত্যাগ করে, কেউবা যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়, আবার কেউবা নবুওয়াত দাবী করে বসে। এমন এক চরম অবস্থায় অনেকে পরামর্শ দিলেন ওসামার বাহিনী পাঠানোর ব্যাপারটি স্থগিত রাখতে। কিন্তু তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে এ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে হযরত উসামা’র বাহিনীকে যাত্রার নির্দেশ দেন।
রিদ্দার যুদ্ধ:
হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহুর শাসনকালের (৬৩২-৩৪ খ্রিষ্টাব্দ) অধিকাংশ সময় রিদ্দার যুদ্ধে অতিবাহিত হয়। রাদ্দা আরবী শব্দ। এর অর্থ হল প্রত্যাবর্তনকরণ। নও-মুসলমানরা যাতে তাদের পূর্ব-ধর্মে প্রত্যাবর্তন না করে, তার জন্য এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
হযরতের ওফাত পরবর্তীতে নব্য মুসলিম আরববাসীদের মধ্যে ধর্মত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। সমগ্র উপদ্বীপের লোক স্বধর্মে ফিরে যাওয়া ছিল নব্য প্রতিষ্ঠিত মদিনা ইসলামী প্রজাতন্ত্র এবং ইসলামের প্রতি একটি বিরাট হুমকি। স্বাধীনচেতা আরব জাতি ইসলামের বিধি নিষেধ, নৈতিক অনুশাসন ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। হযরতের ইন্তেকালের পর তারা ইসলামের বিধানসমূহের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ বিদ্রোহ করে আগের জীবন ধারায় ফিরে যায়। তিনি এ ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করে স্বধর্মত্যাগীদের আন্দোলন দমন করার লক্ষ্যে তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদেরকে ইসলামী জীবনধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।
যাকাত আদায়ে কার্যকরী ভূমিকা :
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের সুযোগে এবং হযরত আবু বকরের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকার সুযোগে একদল লোক যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি প্রদান করে যাকাত বিরোধী আন্দোলন শুরু করে এবং কোনো কোনো প্রভাবশালী লোক যাকাত প্রথা উচ্ছেদেরও সুপারিশ করে। কিন্তু তিনি শরীয়তের সিদ্ধান্তে অটল থেকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, “আল্লাহর কসম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় উটের যে বাচ্চাটি যাকাত হিসেবে দেয়া হতো, এখন যদি কেউ সেটিও দিতে অস্বীকার করে তাহলেও আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।” ফলে তারা যাকাত প্রদানে বাধ্য হয়।
মিথ্যা নবুয়তের দাবিদারদের বিরুদ্ধে অভিযান :
নবীজির ইন্তেকালের পর কিছু সুযোগসন্ধানী লোক নবুওয়াতের মিথ্যা দাবি করে বসে। হযরতের শেষ জীবনে এবং পরবর্তী সময় বেশকিছু ভÐ নবীর আবির্ভাবও ঘটে। এদের মধ্যে আসাদ আনাসী, মুসায়লামা কায্যাব, তুলায়হা, সাজাহ্ প্রমুখ। এদের মধ্যে আসাদ আনাসী নবীজির সময়ে আততায়ীর হাতে নিহত হয়। বাকীদের সকলকেই হযরত আবু বকর দমন করেন।
ভÐনবীরা মদিনাভিমুখে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস পেলে আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু ওদের দমনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। তিনি তাদেরকে আত্মসর্ম্পণ করার কঠোর নির্দেশ দান করেন। অন্যথায় যুদ্ধ অনিবার্য বলে ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি নিজে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপর দিকে হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহুকে ভÐনবী আসওয়াদকে দমনের জন্য সিরিয়া অভিযানের র্নিদেশ প্রদান করেন। আসওয়াদ এক বিরাট সৈন্যদল গঠন করে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হযরত ওসমানের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তার মৃত্যু হয়।
আসওয়াদের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং মুসলমানদের রাজধানী মদিনা অবরুদ্ধ করার প্রয়াস পায়। হযরত আবু কবর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু তাই মদিনা নগরীকে সুরক্ষিত করেন এবং সৈন্যবাহিনীকে ১১টি ভাগে বিভক্ত করে প্রতেকটি সৈন্যদলের নেতৃত্বে একজন অভিজ্ঞ সেনাপতিকে নিয়োগ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভÐনবি ও ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে তাদের প্রেরণ করেন। সেনাপতি খালিদ বিন ওলীদ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু ৩৫০০ সৈন্য নিয়ে ভÐনবী তোলায়হার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এভাবে হযরত খালিদ বিন ওলীদ তোলায়হাকে সহজেই পরাজিত করেন। সে সাইবেরিয়াতে পলায়ন করে অবশেষে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে খালিদ অপর ভÐ নবী মুসায়লামাকে ইয়ামামার যুদ্ধে পরাজিত করেন।
মুহাজীর বিন আবি উমাইয়াকে ইয়েমেন ও হাযরামাউথ আক্রমণ করতে পাঠান হয়। সিরিয়ার সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য এক দল সৈন্য এবং আম্মান ও মাহরাতে বিদ্রোহ দমনের জন্য অপর দুই দল সৈন্য প্রেরণ করেন। বুজাহ্ গোত্রের শক্তি খর্ব করার জন্য এক দল এবং বানু সালমা ও হাওয়াযিন গোত্রকে দমন করার জন্য অপর এক সৈন্য দল পাঠান। হযরত আবু বকর স্বয়ং প্রধান সেনাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মদিনায় তাঁর সৈন্য দলের ঘাঁটি ছিল। এখান থেকে তিনি সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করতেন।
হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে তাদেরকে কঠোর হাতে দমন করে ইসলামী খেলাফতকে সংকটমুক্ত করেন। এ জন্য ঐতিহাসিকরা তাঁকে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলে অভিহিত করেন।
কুরআনের পাÐুলিপি সংরক্ষণ :
তিনি ইসলামের সবচেয়ে বড় যে খেদমতটি করেছেন তা হলো, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্ষিপ্তভাবে থাকা পবিত্র কুরআনের পাÐুলিপিগুলো একত্রিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ কপি তৈরি করেন, যা মাসহাফে সিদ্দিকী নামে খ্যাত। আর এ মাসহাফে সিদ্দিকীই পরবর্তী সময়ে পবিত্র কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলনে মূল ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
উপসংহার :
খলিফা হিসেবে তাঁর অবদান সত্যিই অনবদ্য। অভ্যন্তরীণ বিশৃংঙ্খলা দূর, জাতীয় সংহতি অর্জন এবং ইসলামের প্রভাব স¤প্রসারণের পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি পরবর্তী অগ্রগতির পথ সুগম করেন। তিনি অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবেলা করেছেন প্রতিটি ফিতনা ও পরিস্থিতির। যেই পরিস্থিতিগুলোর এক একটি থেকে অসংখ্য ফিতনা সৃষ্টি হওয়ার আশংকাকেও তিনি অংকুরেই বিনষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অনুপম শিক্ষার উপকরণ হিসাবে কেয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। তাঁর মাত্র আড়াই বছরের খিলাফতের সময়টুকু ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এ বহুবিধ কৃতিত্বের জন্যই তাঁকে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয়।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ