ক্যাম্পে আবারও নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন দ্রুত করার বিকল্প নেই

12

 

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ’র হত্যাকান্ডের রেশ না কাটতেই আবারও বড় ধরনের হামলা হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসায় ঘুমন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ব্রাশফায়ার করে সন্ত্রাসীরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে তিন শিক্ষক ও এক ছাত্রসহ ছয়জনকে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১২ জন। নশংস হামলার পর কয়েকজনকে গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে সন্ত্রাসীরা। জানা যায়, গত শুক্রবার ভোর রাতে ১২-১৫ জনের একটি সশস্ত্র দল ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসার দিকে যায়। এর কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ ও মানুষের আর্তনাদ শোনা যায়। আশপাশের লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে মাদ্রাসার দিকে গেলে দুর্বৃত্তরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটেছে ৫ থেকে ৭ মিনিট সময়ের মধ্যে। হামলার ঘটনায় রোহিঙ্গা নেতারা দায়ী করেছেন মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা)। তারা বলছেন, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে ইসলামি মাহাস নেতাদের সঙ্গে আরসার বিরোধ চলছিল। অবশ্য পুলিশ রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার অস্তিত্ব স্বীকার করছে না। পুলিশের মতে, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরসার নাম ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাÐ চালাচ্ছে। ওদিকে অনেক রোহিঙ্গার দাবি, মুহিবুল্লাহ হত্যা ও ঘুমন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। তারা বলছেন, আরসার সন্ত্রাসীরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
মুহিব্বুল্লাহ ও মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র হত্যাকাÐের আগেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একের পর এক কেন সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে, এর একটি বিশ্বাসযোগ্য উত্তর খুঁজে পাওয়া জরুরি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা ‘হামলার কারণ এবং কারা হামলা করেছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন।’ আমাদের বক্তব্য-লাগাতার হামলাগুলোর প্রকৃত কারণ ও দায়ীদের পরিচয় সম্পর্কে দ্রুত নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটবে- যা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। অনেক আগে থেকে বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ব্যাপকভাবে মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসা চলছে। মাদক ও অস্ত্রকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী গ্রুপ গজিয়ে উঠছে কি না, সেটাও খুঁজে দেখা দরকার। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রত্যাবাসনপ্রত্যাশী ও প্রত্যাবাসনবিরোধীদের দ্বন্দ্ব কোন পর্যায়ে রয়েছে এবং এ দ্বন্দ্বই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্ম দিচ্ছে কি না, এ ব্যাপারেও গভীর তদন্ত হওয়া দরকার। রবিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত চার বছরে শরণার্থী শিবিরে দায়িত্বরত দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থার কূটচালের পাশাপাশি হতাশাজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে প্রত্যাবাসন বিরোধী ২০টিরও অধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ ও সংগঠনের তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিজেদের অভ্যন্তরীণ স্বার্থগত দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারে এসব সশস্ত্র সংগঠন হরহামেশা প্রাণঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ও অস্ত্রের কারবারে জড়িয়ে পড়ে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে গত চার বছরে দুইশ’ ৩২ জন রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনাও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্রমেই হুমকি হয়ে উঠছে। একের পর এক খুনখারাবির ঘটনা বড় অঘটনের ঝুঁকি তৈরি করছে। এ অবস্থায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সাথে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে এমন দূর-নিকটতম ও প্রতিবেশি দেশগুলোকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে যুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্যই চার বছর ধরে প্রয়াস চালিয়ে আসছে ভারত, চীন, রাশিয়া ও জাপানকে এ প্রক্রিযায় ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করতে। কিন্তু নানা সমীকরণে তারা মৌখিকবাবে প্রতিশ্রæতি দিলেও বাস্তবে দূর নিকটেই থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে যেন। আমরা মনে করি, সরকারকে যেকোন কিছুর বিনিময় তাদের এক জায়গায় আনতেই হবে। না হয়, সব চেষ্টা ফিলেই যাবে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে যে কথাটি বলেছেন, আমরা তাঁর প্রতিধ্বনি করি, ‘রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এটাই এখনকার বাস্তবতা’। রোহিঙ্গা শিবিরের সকল উত্তেজনা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বন্ধে প্রত্যাবর্তনের বিকল্প কোন পথ নেই।