কৌশলে প্রাইভেট কারে তুলে অস্ত্রের মুখে পালাক্রমে ধর্ষণ

123

নগরীতে এক মাদ্রাসাছাত্রীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলন্ত অবস্থায় পালাক্রমে ধর্ষণ করেছেন দুই প্রাইভেট কার চালক। তারা হচ্ছেন শাহাব উদ্দিন (২৩) ও শ্যামল দে (৩০)। শাহাব উদ্দিন কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ার মধ্যম কৈয়ারবিল এলাকার মফজল মিয়ার ছেলে। তিনি চেরাগী পাহাড় এলাকার এক চিকিৎসকের প্রাইভেট কার চালক। আর শ্যামল দে রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া কালিপাহাড় এলাকার হরি কুমার দে’র ছেলে। তিনি জামালখান আইডিয়াল স্কুল সংলগ্ন এলাকার এক ব্যাংক কর্মকর্তার প্রাইভেট কার চালক। গত রবিবার এ ঘটনা ঘটে। এদিকে ধর্ষণে জড়িত শাহাব উদ্দিন গতকাল মঙ্গলবার ভোরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। আর শ্যামলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তিনি আদালতে স্বাীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গতকাল কোতোয়ালী থানায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান।
মেহেদী হাসান জানান, ‘ভিকটিম একজন মাদ্রাসাছাত্রী। তাকে ধর্ষণের পরিকল্পনা করেছিল শাহাব উদ্দিন। তার পরিকল্পনায় সহযোগী ছিল শ্যামল দে। গত রবিবার সকালে তারা দুইজন মিলে ওই ছাত্রীকে প্রাইভেট কারে তুলে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে গণি বেকারি মোড়ে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে ওই ঘটনা কাউকে না বলতে হুমকি দেয়। পরে মেয়েটি ভাইকে সাথে নিয়ে থানায় এসে পুলিশকে এ ঘটনা জানালে অভিযান চালিয়ে শ্যামলকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দুইটি প্রাইভেট কার জব্দ করা হয়। পুলিশের কাছে প্রাথমিক স্বীকারোক্তিতে দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে ধর্ষণের শিকার ওই মেয়েটির বর্ণনার মিল পাওয়া যায়। পরে শ্যামল ঘটনায় জড়িত শাহাব উদ্দিনের পরিচয় পুলিশকে জানায়।
মেহেদী হাসান বলেন, গত রবিবার সকালে মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে জামালখান মোড়ের পিডিবি আবাসিক এলাকার সামনে মেয়েটিকে দেখে একটি প্রাইভেটকার দাঁড়ায়। এ সময় গাড়িতে থাকা শাহাব উদ্দিন মেয়েটির কাছে রীমা কমিউনিটি সেন্টার কোন দিকে তা জানতে চান। মেয়েটি তা দেখিয়ে দেওয়ার পর তারা চিনবে না বলে মেয়েটিকে গাড়িতে উঠতে বলে। মেয়েটি গাড়িতে উঠার পর তা চালিয়ে চলে যায়। পরে তারা অস্ত্রের মুখে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। এ সময় তারা মেয়েটির মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ও মোবাইল ফোনে ধর্ষণ চিত্র ধারণ করার অভিনয় করে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে বলে দেয়।
পরদিন সোমবার মেয়েটি অভিযোগ করলে ধর্ষকদের ধরতে অভিযানে নামে পুলিশ। শ্যামল দে নামের গাড়িচালক শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে মিলে তাকে ধর্ষণ করেছে বলে মেয়েটি অভিযোগ করে।
তিনি বলেন, প্রথমে শ্যামলকে (৩০) গ্রেপ্তারের পর মেয়েটি তাকে শনাক্ত করে। পরে শাহাব উদ্দিনকে ধরতে গেলে মেরিনার্স রোডে পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সে নিহত হয়।
উপ-কমিশনার মেহেদী বলেন, গাড়িচালকদের একটি চক্র এ ধরনের অপরাধ করে আসছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ ছিল। সোমবার মেয়েটি এসে একই ধরনের অভিযোগ করে।
শ্যামলকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) কামরুজ্জামান বলেন, রবিবার রীমা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে যাওয়ার পর মেয়েটি তাকে নামিয়ে দিতে বললেও তারা না নামিয়ে সার্সন রোডের দিকে চলে যায়। এ সময় শ্যামল গাড়ির চালকের আসনে ছিলেন। শাহাবউদ্দিন মেয়েটিকে ধর্ষণ করে চালকের আসনে বসে ও পরে শ্যামল তাকে ধর্ষণ করে। এ সময় তারা কেউ গাড়ি থেকে না নেমে সিটের পাশ দিয়েই যাওয়া-আসা করে। পরে মেয়েটিকে গণি বেকারি এলাকায় নামিয়ে দিয়ে তারা পালিয়ে যায়।
কামরুজ্জামান বলেন, ঘটনার পরদিন সোমবার সকাল থেকেই শাহাব উদ্দিন মেয়েটিকে ফোন করে তার সাথে দেখা করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। দেখা না করলে ধর্ষণের ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
এরপর মেয়েটি থানায় অভিযোগ করে জানিয়ে তিনি বলেন, শাহাব উদ্দিন সোমবার সন্ধ্যায় মেয়েটিকে দিদার মার্কেটের সাফা আর্কেড কমিউনিটি সেন্টার এলাকায় অবস্থান করতে বলেন। মেয়েটিকে সেখানে দাঁড় করিয়ে আমরা ফাঁদ পাতি। এ সময় শাহাব উদ্দিন তার অপর এক সহযোগীকে নিয়ে সেখানে আসে। মেয়েটি গাড়ির সামনে গেলে তাকে টেনে তুলে চকবাজারের দিকে দ্রæত চলে যায়। গাড়িটিকে ধাওয়া করে পুলিশ গাড়ির নম্বরটি বিভিন্ন স্থানে ওয়্যারলেসে মেসেজ দেয়। পরে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। গাড়িটি বিভিন্ন দিকে ঘুরে লালদীঘির মাঠের সামনে পৌঁছালে শাহাব উদ্দিন মেয়েটিকে রেখে গাড়ি থেকে নেমে হকার্স মার্কেটের ভেতর দৌঁড়ে ঢুকে যায়। পরে লালদীঘির মাঠের সামনে থেকে গাড়িটি আটক করে মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়।
কামরুজ্জামান জানান, ওই গাড়িটি একজন ব্যাংক কর্মকর্তার, সেটি চালাতেন শাহাব উদ্দিন। রাতে চকবাজার ডিসি রোড থেকে শ্যামলকে গ্রেপ্তারের পর ধর্ষণের ঘটনায় ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি আটক করা হয়। ওই প্রাইভেটকারটি একজন চিকিৎসকের।
তিনি বলেন, শ্যামল বলেছে, রবিবার সকালে সে তার মালিকের ছেলেকে কলেজে পৌঁছে দেওয়ার পর শাহাব উদ্দিন তাকে ফোন করে জামালখান এলাকায় আসতে বলে। আর আগে থেকেই সেখানে শাহাব উদ্দিন অবস্থান করছিলেন। শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এর আগেও এসেছিল।
নিহত শাহাব উদ্দিন সোমবার সন্ধ্যায় অন্য যাকে নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তার নামও শাহাব উদ্দিন বলে জানান পরিদর্শক কামরুজ্জামান।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওসি মো. মহসীন বলেন, রবিবার ছাত্রীটিকে তোলার পর গাড়িটি সার্সন রোডের দিকে চলতে থাকে। সাহাব উদ্দিন ভিকটিমকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। পর্যায়ক্রমে ড্রাইভিং সিটে থাকা শ্যামল দে পিছনে এসে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। আসামি সাহাব উদ্দিন গাড়ি চালানো অবস্থায় ভিডিও ধারণ করে। এরপর জড়িত দুজন মিলে ভিকটিমকে ভিডিওটি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। এরপর কাউকে কিছু না বলার কথা বলে ভিকটিমকে গণি বেকারির মোড়ে বেলা পৌনে ১২ টার দিকে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায়। নামিয়ে দেওয়ার আগে ভিকটিমের মোবাইল থেকে ডায়াল করে আসামিরা ভিকটিমের মোবাইল নম্বর নিয়ে নেয়। এ সময় মেয়েটিকে হুমকি দিয়ে সাহাব উদ্দিন বলে, আমি ফোন দেয়ার সাথে সাথে যদি তুমি না আস, তাহলে তোমার ধারণ করা ভিডিও ইন্টারনেট ছড়িয়ে দিব।
ভিকটিম লোকলজ্জায় অপহরণ ও ধর্ষণের বিষয়টি পরিবারের সবার কাছে গোপন রাখে জানিয়ে ওসি বলেন, আসামি সাহাব উদ্দিন তার ফোন থেকে গতকাল সোমবার সকাল থেকে পুনরায় ভিকটিমকে ফোন দিয়ে আসার জন্য বলে, না আসলে ভিডিও নেটে ছেড়ে দেবে বলে ধমক দিতে থাকে। ভিকটিম এক পর্যায়ে উপায় না দেখে, তার ভাইকে বিষয়টি জানায়। তার ভাই বিস্তারিত শোনার পর সেমাবার বিকেলে কোতোয়ালী থানা পুলিশের শরণাপন্ন হন।
এরপর তাৎক্ষণিক কোতোয়ালী থানা পুলিশের একটি দল আসামিদের ধরার জন্য ফাঁদ পাতে জানিয়ে কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, আসামি সাহাব উদ্দিনের কথামত, ভিকটিম দিদার মার্কেট এলাকায় অবস্থান নেয়। কোতোয়ালী থানা পুলিশও দিদার মার্কেট এলাকায় অবস্থান করে। আসামি সাহাবুদ্দিন, শ্যামল ও অপর এক আসামি সাহাব উদ্দিনসহ সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে ভিকটিমকে দ্রæত গাড়িতে তুলে নেয়। পুলিশ গাড়িটির পিছু নিয়ে ধাওয়া করে। প্রাইভেট কারটি প্যারেড কর্নারের পূর্ব পাশ, কেয়ারি মোড়, চট্টগ্রাম কলেজ, গণি বেকারি, জামালখান হয়ে বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা প্রদক্ষিণ করতে থাকে। সামনে থাকা টহল পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে গাড়িটি বেপরোয়া গতিতে চলতে থাকে।
একপর্যায়ে কোতোয়ালী থানাধীন লালদীঘির পাড়স্থ জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে পুলিশের বেরিকেডের মাঝে পড়ে যায়। গাড়িটি পুলিশের বেরিকেডের মধ্যে পড়ে যাওয়ার বিষয়ে বুঝতে পেরে আসামিরা দ্রুতবেগে গাড়ি থেকে নেমে কোলাহল পূর্ণ পৌর জহুর হকার্স মার্কেটের ভিতরে ঢুকে যায়। পুলিশ পিছু ধাওয়া করলেও জহুর হকার্স মার্কেটের ভিতরে প্রচুর লোক সমাগম থাকায় আসামিরা দ্রুত সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যেতে সক্ষম হয়। পুলিশ জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে থেকে ভিকটিমকে উদ্ধার করে এবং অপরহরণ কাজে ব্যবহৃত প্রাইভেট কার (চট্টমেট্রো-গ-১৩-৪১৫১) জব্দ করে।’
মহসীন বলেন, এরপর প্রাইভেট কারের সূত্র ধরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে শ্যামল দে কে ডিসি রোড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার ও অপহরণ কাজে ব্যবহৃত প্রাইভেট কার (চট্টমেট্রো-গ-১২-৩০৫২) জব্দ করে পুলিশ।
ওসি মহসীন বলেন, ‘মঙ্গলবার (গতকাল) ভোরে কোতোয়ালী থানার মেরিনার্স রোডে শাহাব উদ্দিন অবস্থান করছে জানতে পেরে কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে অভিযান চালায়। পুলিশের অবস্থার টের পেয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে শাহাব উদ্দিন ও তার অপর সহযোগী। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে শাহাব উদ্দিনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকর তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
ঘটনাস্থল থেকে একটি এলজি, চার রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা এসএম মেহেদী হাসান।
আদালতে শ্যামলের স্বীকারোক্তি : মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার জড়িত থাকার অভিযোগ আদালতে স্বীকার করেছেন শ্যামল দে। গতকাল মঙ্গলবার মহানগর হাকিম মোহাম্মদ খাইরুল আমীনের আদালত শ্যামলের জবানবন্দি ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করেছেন বলে জানান কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান।