কৌশলে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে

10

বেশ কয়েকমাস ধরে নিত্যপণ্যের সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছর জুন মাসে এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, একসাথে ৫৩টি ওষুধ বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। ওইসময় এ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি হলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বিষয়টিকে মূল্য বৃদ্ধি বলতে রাজি ছিল না। তাদের দাবি, ওষুধে ব্যবহৃত কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় এর সঙ্গে সমন্বয় করে ওষুধের দাম কিছুটা ‘আপডেট’ করা হয়েছে মাত্র। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, শুধু কাঁচামালের দামই বাড়েনি, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময় মূল্য, মুদ্রাস্ফীতিসহ নানা কারণেই ওষুধ উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। এসব কারণে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি কোম্পানিগুলো প্রকাশ্যে বা ঘোষণা দিয়ে ওষুধের দাম না বাড়িয়ে নতুন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রশাসনের নজর এড়িয়ে মুঠোফোনে ফার্মেসি মালিকদের কাছে খুদে বার্তা প্রেরণ করে খেয়াল খুশিমতো ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। আশ্চর্যজনক হলো, প্রায় এক বছর যাবৎ একাধিক প্রতিষ্ঠান বিপণন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এভাবে অবৈধ পন্থায় দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকলেও সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এর কিছুই জানে না বলে জানিয়েছে। ওষুধ প্রশাসনের এমন নির্লিপ্ততা হাস্যকর। বাজারে বিনা ঘোষণায় ওষুধের দাম বাড়ছে আর কর্তৃপক্ষ কিছুই জানে না, তবে তাদের কাজ কি? তাদের এমন যুক্তি কি বিশ্বাসযোগ্য? বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, কোনো ওষুধ বাজারে চলে যাওয়ার পর মুঠোফোনে খুদে বার্তা প্রেরণ করে সেটির দাম বাড়ানোর এখতিয়ার কোনো কোম্পানির নেই; দাম বাড়ানোর আগে অবশ্যই অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। আমরা জানি, গত বছরের ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় ‘প্রাইস ফিক্সেশন পলিসি’ অনুসারে ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ওষুধের পুনঃর্নির্ধারিত দাম অনুমোদন করেছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
দাম বৃদ্ধির কারণ হিসাবে তখন ওষুধের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। বছর না গড়াতেই সেই একই খোঁড়া যুক্তি সামনে এনে গোপনে মুঠোফোনে খুদে বার্তা প্রেরণ করে মূল্যবৃদ্ধির খেলায় মেতে ওঠা অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাÐ, যা শক্ত হাতে রোধ করা প্রয়োজন। উদ্বেগজনক হলো, বর্তমানে একজন রোগীর মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশই ওষুধ ক্রয়ে খরচ হচ্ছে। এমন বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে বছরে অন্তত ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত বছরের মে মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ; পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ক্রমাগতভাবে যার উল্লম্ফন ঘটেছে। বস্তুত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির প্রভাব নি¤œ আয়ের মানুষকে চরম দুরবস্থায় নিপতিত করেছে। এমনিতেই করোনার কশাঘাতে চাকরিহারা, বেকার ও আয়-রোজগার কমে যাওয়া জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন খরচের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। এরমধ্যে ওষুধ কোম্পানিগুলোর এমন লোকোচুরি ভাব কোনভাবেই কাম্য নয়। ওষুধ সেবন ছাড়া মানুষ ধুকে ধুকে মরবে!
উদ্বেগের বিষয়, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে দেশে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। কার্যত প্রায় গোটা ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে ওষুধ শিল্প মালিক সমিতি। সরকারের আইনের দুর্বলতার কারণেই ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য আইন সংশোধন করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক এ দুর্যোগের সময় কেউ যদি ওষুধের সংকট তৈরি করে বা বেশি দাম নেয়, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এটা মানুষের জীবনরক্ষার উপকরণ। কাজেই ওষুধের ব্যবসার সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা ও মানবিক হওয়া প্রয়োজন। জনগণের চিকিৎসা ব্যয় কমাতে ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের তদারকি বাড়ানোর বিকল্প নেই।
অভিনব পদ্ধতিতে খুচরা বাজারে ওষুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে। গতকাল যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার ওপর মূল্যস্ফীতির চাপে বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছে অনেক পরিবার। এ অবস্থায় ওষুধের দাম বৃদ্ধি তাদের জীবনে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে সরকারের হাতে। তবে ওষুধের এ মূল্যবৃদ্ধির আগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে মানুষকে তা অবহিত করার নিয়ম রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের যখন নাভিশ্বাস অবস্থা, তখন কোনোরকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই শুধু মুঠোফোনে খুদে বার্তা প্রেরণ করে ওষুধের দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ রোগীরা বিপাকে পড়েছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশীয় কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে; অথচ এক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ভূমিকা মোটেই সন্তোষজনক নয়। বস্তুত ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হলে রোগী ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উভয়ের স্বার্থই রক্ষা পাবে। এ ব্যাপারে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।