মধ্যাহ্নের খানিক অবসরে চেম্বারের জানালাপথে তাকিয়ে ভাদ্রের রুদ্র রুপ দেখছিলাম। ক্লান্ত একটা চিল পাক খাচ্ছে আকাশে। ‘আদাব’ ডাক শুনে দৃষ্টি ফিরিয়ে চেম্বারের দরজায় দাঁড়ানো পূর্বপরিচিতা কালোছাপা শাড়ি পরিহিতা ফর্সা মধ্যবয়সী অধ্যাপিকাকে স্বাগতম জানালাম। তাঁর অভিযোগসম‚হের সারসংক্ষেপ হচ্ছে: তাঁর হাতের তালু এবং আংগুলের ডগার কাছাকাছি খসখসে হয়ে পড়েছে। আরো জানা গেলো যে, গত মাস দুয়েক ধরে তিনি দৈনিক দশ-বারোবার টয়লেট সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে চলেছেন কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করার স্বাস্থ্যবিধি হিসেবে। আপাততঃ রোগ নির্ণয় : কনটাক্ট ডারমাটাইটিস। যথারীতি ব্যবস্থাপত্র লিখে তাঁর বারংবার হাতধোয়া যথারীতি বজায় রাখার জন্য তাঁকে উপদেশ দিলাম এবং সে সংগে পরামর্শ দিলাম হাত ধোয়ায় টয়লেট সাবান ব্যবহার না করে হ্যান্ডওয়াশ এবং হ্যান্ডলোশান বা ক্রীম ব্যবহার করার জন্যে। আমার পরামর্শে অধ্যাপিকা আশ্বস্থ হলেন এবং সন্তুষ্টচিত্তে ব্যবস্থাপত্রসহ বিদায় নিলেন। ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো এ কারণে যে, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে আবার চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়াটা বাঞ্চনীয় নয়। এ জন্য আমাদের চর্মরোগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা জরুরি।
দেহত্বকের স্তরসম‚হ সম্পর্কে তথ্যাদি : দেহত্বক হচ্ছে মানবদেহের সবচেয়ে বাহিরের আচ্ছাদন যাহা এপিডারমিস ও ডার্মিস নামক প্রধান দুইটি কোষীয় স্তর দ্বারা গঠিত এবং যাহা দেহের অভ্যন্তরীন এবং বাহ্যিক পরিবেশের মধ্যস্থলে অবস্থান করে দেহকে বহিঃপরিবেশের নানাবিধ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। দেহত্বক তিনটি স্তরে বিভক্ত ঃ
১. এপিডার্মিস বা বহিত্বক বা বাহিরের স্তর ২. ডার্মিস বা অন্তঃত্বক বা ভেতরের স্তর ৩. সাবকিউটিনাস কলা বা নিচের স্তর।
এপিডার্মিস পাঁচটি উপস্তরে বিভক্ত এবং ডার্মিস দুটি উপস্তরে বিভক্ত। সাবকিউটিনাস কলা ডার্মিসের নিচে অবস্থিত। ত্বকের এই স্তর নিম্নর্বুী পেশী,কলা এবং অন্যান্য অংগকে রক্ষা করে। ডার্মিসের ভিতর জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য রক্তনালী, শিরা, স্নায়ু, অজস্র কোষ, ঘামের ও তেলের গ্রন্তি। ঘর্মগ্রন্তি রক্তের ভেতর থেকে শুষে নেয় পানি, লবণ এবং কিছু রেচন পদার্থ। তারপর ঘাম আকারে ঘর্মনালীর মধ্যে বেরিয়ে আসে দেহের বাইরে। এই ঘর্মগ্রস্থি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিরাট ভ‚মিকা রাখে। তৈলগ্রস্থি থেকে বেরোয় তেলজাতীয় পদার্থ বা সেবাম। এই সেবাম ত্বক ও লোমকে মসৃণ রাখে।
হাতের ত্বকের বিশেষত্ব : হাতের ত্বকের স্তরসম‚হের পুরুত্ব দেহের অন্যান্য জায়গার ত্বকের স্তরসম‚হের পুরুত্বের চেয়ে বেশি। এখানকার সাবকিউটিনাস কলায় চর্বির স্তর বেশ মোটা যা হাতের কোমলতার জন্য দায়ি। হাতধোয়া বলতে কি বুঝায় ?
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, বিবিধ ক্ষতিকারক আনুবিক্ষণিক জীব কনা,ময়লা তৈলাক্ত বর্জ্য, ধুলাবালি ইত্যাদি যেগুলো মানবদেহে রোগ সংক্রমণ ঘটায় সেগুলো মেরে ফেলা বা অপসারণের জন্য সাবান ও পানি দ্বারা যথানিয়মে হাত পরিষ্কার করাই হচ্ছে হাতধোয়া।
হাতধোয়ার ইতিহাস : উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি হাংগেরী নিবাসী চিকিৎসক ইগনাস সেমেলিউস এবং আধুনিক নার্সিং-এর প্রবক্তা বৃটেনের ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল প্রসুতি ও যুদ্ধাহত সেনাদের পরিচর্যায় হাত ধোয়াকে সর্বপ্রথম গুরুত্বপ‚র্ণ বলে অভিহিত করেন। হাত ধোয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ক. হাতকে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য জীবাণুমুক্ত করা। খ. সংক্রমন প্রতিরোধ করা যেহেতু মানুষ কারণে অকারণে হাত, মুখ, চোখে হাত দিয়ে থাকে। গ. ডায়রিয়া,শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমন, চর্মরোগ, চক্ষুরোগ প্রতিরোধ করা। ঘ) ২০১৮ সালে ইউএসডিএ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০ শতাংশ মানুষ সঠিক নিয়মে হাতধোয়া সম্পন্ন করেন না। অপর এক পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে যে, সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার নিয়মাবলী যেসমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী মেনে চলেন তাঁরা অন্যদের যারা হাত ধোয়ার নিয়মাবলী অনুসরণ করেন না তাদের থেকে ২০ শতাংশ কম অসুস্থ হন। কখন হাত ধোবেন?
ক. জনসমাগম থেকে আসার পর
খ. বাহির থেকে ঘরে প্রবেশ করে পোশাক পরির্বুন করার পর
গ. রান্নার কাজ শুরু করার আগে এবং শেষ করার পর
ঘ. বাথরুম ব্যবহারের পর
ঙ. কাটা-ছেঁরা ড্রেসিং করলে
চ. অসুস্থ ব্যক্তির পরিচর্যার আগে ও পরে
ছ. খাওয়ার আগে ও পরে
জ. বাচ্চাদের ডায়াপার পরির্বুন করার পর
ঝ. পোষা বিড়াল, কুকুর, পাখি স্পর্শ করলে
ঞ. হাঁচি দেয়ার পর
ট. এমন কিছু স্পর্শ করা যেমন,দরজার নব, টেবিল হাতল যেগুলি অন্যরা বারবার স্পর্শ করছেন
ঠ. মুখ স্পর্শ করার পূর্বে
ড. ঘরের জমা হওয়া পুরানো জিনিসপত্র স্পর্শ করলে হাত ধোয়ায় কি ব্যবহার করবেন ?
ক. ময়শ্চারাইজার ও সম্পূর্ণ ফ্যাটি মেটার ৭০ শতাংশ সমৃদ্ধ সাবানসমূহ। যেমন ; সাদা লাক্স,সাদা ডোব, লাইফবয় টোটাল ইত্যাদি। খ) ময়শ্চারাইজার সমৃদ্ধ তরল সাবান বা হ্যান্ড ওয়াশ।
গ. ময়শ্চারাইজার সমৃদ্ধ হ্যান্ড সেনিটাইজার
ঘ. হাতের কাছে কিছু পাওয়া না গেলে পরিষ্কার পানি।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত হাত ধোয়ার সাতটি ধাপঃ ২০ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে নিচের সাতটি ধাপ সম্পন্ন করতে হবে।
১. হাত ভিজিয়ে প্রয়োজনীয় তরল হ্যান্ডওয়াশ মেখে ফেনা তুলুন। ২. দুই হাতের তালু পরস্পর ঘষবেন। ৩. হাতের পিঠ ঘষবেন। ৪. দু’হাতের আংগুলসম‚হ পরস্পর যোগ করে ঘষবেন। ৫. হাতের আংগুল মিলিয়ে কাপের মতো করুন।
৬. দু’হাতের বৃদ্ধাংগুলি পরিষ্কার করবেন। ৭. এক হাতের তালু অন্য হাতের আংগুল দ্বারা ঘষবেন।
হাত ধোয়ার সময় যা করবেন না :
(১) ডিটারজেন্ট বা ডিশসোপ কখনও হাতে লাগাবেন না।এগুলো হাতের ত্বকের উপরের স্তরকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। (২) কড়া কেমিকেল আছে এমন সাবান ব্যবহার করবেন না।
(৩) চর্মরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এন্টিব্যাকটেরিয়াল সাবান ব্যবহার করবেন না। এগুলো হাতের ত্বক থেকে প্রাকৃতিক ফ্যাট এবং তেল বের করে দেয় যার ফলে হাতের ত্বক রুক্ষ্ণ হয়ে পড়ে।
(৪) রেস্টরুমে বা বাথরুমে হ্যান্ড ড্রায়ার দ্বারা কখনও হাত শুকাবেন না।তাপ হাতের রুক্ষ্ণতা বাড়ায়।
হাত ধোয়ার সময় যা করবেন: (১) হাত ধোয়ার সময় প্রয়োজনমতো পানি ব্যবহার করবেন। যেহেতু হাতে সাবান লেগে থাকলে তা ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি করে। (২) হাত ধোয়ার পর তৎক্ষণাৎ দু’হাতে ময়শ্চারাইজার লাগাবেন। ব্যাগে সর্বদা আপনার পছন্দমতো ময়শ্চারাইজার রাখবেন।যেমন, কোকোনোট বডি অয়েল, পেট্রোলিয়াম জেলি, ইত্যাদি।
৪. সেনিটাইজার ব্যবহার করার পর হাতে ময়শ্চারাইজার, তেল কিংবা লোশান লাগাবেন।
৫. কাপড় কাচা, বাসন মাজা ও ঘর মোছার কাজে অবশ্যই দু’হাতে গ্লাভস পরিধান করবেন।
হাতের ত্বকের যত্নে করণীয় :
ক) বার বার হাত ধোয়ার প্রয়োজন হলে সাবান ব্যবহার না করে হ্যান্ডওয়াশ ব্যবহার করবেন এবং হাত ধোয়ার পর হ্যান্ড লোশান বা হ্যান্ড ক্রিম লাগাবেন।
খ) হাতে গ্লাভস পরিধান করা :
১) অতিরিক্ত পানি ব্যবহার হয় এমন কাজ করলে ২) এমন সাবান নিয়ে কাজ করা যেগুলোতে ক্ষারীয় পদার্থ বা কেমিকেল বেশি মেশানো আছে। গ্লাভস ব্যবহার করার কারণে হাতের ত্বক সরাসরি কেমিকেলের সংস্পর্শে আসবে না এবং ত্বকের ক্ষতিও কম হবে। গ) চিনাবাদামে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে।তাই নিয়মিত চিনাবাদাম খাবার অভ্যাস করলে হাতের ত্বকের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। ঘ) প্রচুর শাকসব্জী খাবেন এবং পর্যাপ্ত পানি পান করবেন।
ছ) যে সমস্ত সাবান ব্যবহার করবেন না। সিনথেটিক, সুগন্ধী, প্রিজারভেটিভ, সালফেট আছে এমন সাবান ব্যবহার করবেন না।এগুলোতে অবস্থিত রাসায়নিক পদার্থ হাতের ত্বকের চর্বিও স্তর নষ্ট করে হাতের ত্বককে রুক্ষ করে দেয়।
উপসংহার : স্বাস্থ্যগত বা সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বার বার হাত ধোয়ার প্রয়োজন হলে সেটা অবশ্যই পালনীয়।তবে সে সংগে হাতের ত্বকের ক্ষতি যেন না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রাবন্ধিক