কোভিড পরিস্থিতি : শিক্ষায় চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

11

 

কোভিড রোগটি জানান দিল প্রকৃতির উপর আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যতই বাড়াই না কেন, আমাদের শারীরিক সক্ষমতাকে অতিক্রম করে ভয়েজার-১,২ দিয়ে সৌরজগত ছেড়ে যাই না কেন, প্রকৃতি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে প্রকৃতি চড়াও হয়ে উঠতে পারে, আমাদেরকে অসহায় করে দিতে পারে, আমাদের পরিস্থিতিতে সংকট তৈরি করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে সংক্রামক ব্যাধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ মানুষের বেঁচে থাকার পথে, এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। এতে মানুষের জীবনমান, শিক্ষা, কৃষি উৎপাদনে যেমন সংকট দেখা দিয়েছিল তেমনি মানুষের জীবনও ঝুঁকিতে বা চ্যালেঞ্জে পড়েছিল। অন্যপ্রাণীরা, তাদের জীবন সংকট ও ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাদের অনেক প্রজাতি অতীতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখনও কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির পথে,যাদের সংকটাপন্ন বা বিপন্ন প্রজাতি বলা হচ্ছে। তারা সংকট মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে, জীবনের ঝুঁকি কাটিয়ে উঠার দক্ষতা প্রকাশ করতে না পারলে সামনে তারাও ধ্বংস বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। চ্যালেঞ্জ বা ঝুকিঁ মানে চারপাশে এমন একটি বৈরী পরিস্থিতি তৈরি হওয়া যেখানে সৃজনশীল দক্ষতা দেখাতে না পারলে সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারা যায় না। অন্য প্রাণীরা সহজাত প্রবৃত্তি ও প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণে বেচেঁ থাকে বলে তারা একই বৃত্তে বৈচিত্র্যহীন জীবনচক্রে জীবন কাটায়। তাই তারা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে না। কিন্তু মানুষ সৃজশীল চিন্তার অধিকারি বলে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে মানুষ নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এত পথ পারি দিয়ে এই মানবিক ও উন্নত সভ্য সমাজে পৌঁছতে পেরেছে। তার অন্যতম উপায় হল শিক্ষা। আর বাহক হক সভ্যতা ও সংস্কৃতি। আজ সেই উপায়, শিক্ষা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, ঝুঁকিতে পড়েছে। যে শিক্ষা আমাদের প্রজন্মকে তৈরি করে তোলে, যে শিক্ষা দৈহিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশ ঘটায়ে যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করে সে রাস্তা বা উপায় ভেঙে পড়লে, পথ হারালে ঝুঁকিতে পড়লে তার জন্য সমাজ রাষ্ট্রকে পরিকল্পিত ভাবে নানা কার্যক্রম হাতে নিতে হয়। তার মধ্যে জনসচেতনতা ও গৃহীত কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব বহন করে।
কোভিড পরিস্থিতি আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পর ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে। জাতি টিকে থাকার, বিকশিত হওয়ার প্রাণশক্তি হল শিক্ষাকার্যক্রম, রক্ত প্রবাহের মত। সেই প্রবাহ কোভিড পরিস্থতিতে দ্রæত স্বাভাবিক ও গতিশীল করতে পারা হল প্রথম চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হল শিক্ষাকার্যক্রমে যুক্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মচারী,ব্যবস্থাপকগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হল, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও কোভিড প্রতিরোধে নেয়া ব্যবস্থায় সকলকে যুক্ত করতে পারা ও এব্যাপারে সচেতন করতে পারা।
কোভিড পরিস্থিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলায় বড় চ্যালেঞ্জ হল শিক্ষার্থী সুরক্ষায় তার পরিবার সার্বক্ষণিক কোভিড প্রতিরোধে সচেতন থাকতে পারা ও প্রতিষ্ঠানের গৃহীত সুরক্ষা বলয়ের আওতায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে রাখতে পারা।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আমদের করণীয়গুলোতে সঠিকভাবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। প্রথমে আমদেরকে অতি দ্রæত প্রত্যেকের জন্য টিকা নিশ্চিত করা জরুরি। এই কোভিড পরিস্থিতে টিকা না নিতে পারা পর্যন্ত মুখের মাস্ককে যান্ত্রিক টিকা বলে গুরুত্ব দিতে হবে। কোন অবস্থাতেই মাস্ক ছাড়া শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো যাবে না । তাকে বুঝিয়ে বলা টিকা গ্রহণ না করা পর্যন্ত, মুখে পরিধান করা এই মাস্কই তার টিকা। অনেক দিন পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে বলে তার লেখাপড়ার ক্ষতি বা ঘাটতি পূরণের চেয়ে তার মানসিক ও চিন্তার ঘাটতির প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে। যাতে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশের সাথে, সহপাঠিদের সাথে, শিক্ষকদের সাথে সহজে মিশতে পারে, ও আনন্দঘন পরিবেশ পায়, সেই দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও শৃঙ্খলায় সুষ্ঠুতা বজায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারাটা বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হতে পারে। তাই শ্রেণি কক্ষে সামাজিক দূরত্বে শিক্ষার্থীকে বসালেও ক্লাশ শেষে তারা যেন একত্র হতে না পারে, সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে তার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তাতে সহায়তা করার জন্য একাধিক ক্লাশ ক্যাপটেনকে নজরদারির দায়িত্ব দেয়া যায় বা শ্রেণি শিক্ষক, অপর শিক্ষক ক্লাশে প্রবেশ না করা পর্যন্ত অবস্থান করা।
মাস্ক যে যান্ত্রিক টিকা তার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়ে প্রত্যেকের মাস্ক পরিধান করা নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান হতে মাস্ক সরবরাহ করা। প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ মুখে থার্মোমিটার দিয়ে শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মাপার ও মাস্ক পরিধানের বিষয়টি নিশ্চিত করা। চিহ্নিত করা জ্বর সর্দি থাকা শিক্ষার্থীদেরকে কলেজের নির্ধারিত আইসোলেশন কক্ষে রাখা। এই ধরনের শিক্ষার্থীদের তথ্য নথিভুক্ত করা ও তাদেরকে বাসায় পৌঁছিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা। সার্বক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার প্রস্তুতি রাখা। প্রবেশ পথে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা। প্রতিষ্ঠানের ভিতরেও পর্যাপ্ত হ্যান্ডসেনিটাইজার এর ব্যবস্থা রাখা। নির্দিষ্ট সময় পর পর ওয়াশরুম পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করা।
শিক্ষার্থীরা অনুকরণ প্রিয়। প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকের মাস্ক পরিধান করা শুরু থেকেই নিশ্চিত করা, এর জন্য একে অন্যকে তাগদা দেয়া। এই সব কার্যক্রমের দৈনিক প্রতিবেদন তৈরি করা।
শ্রেণিকার্যক্রম শুরুর আগেই চার বা পাঁচ মিনিট স্বাস্থ্য সচেতনতার উপর নির্দেশনা দেয়া। শ্রেণি কক্ষের আনন্দঘন পরিবেশ ধরে রাখার জন্য চিত্তবিনোদন মূলক কিছু করা। পাঠ্যবিষয়ের পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে খেলা যায় কেরাম,দাবা এই জাতীয় খেলাধুলা করার সুযোগ দেয়া। সিলেবাস ও অন্যান্য বিষয়ের আগাম কর্মপরিকল্পনা জানিয়ে দেয়া। প্রথম সপ্তাহ, তাদের মানসিক স্বস্তি ও বিষন্নতা কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক ও প্রাণবন্ত শিক্ষার্থী তৈরি করার দিকে মনোযোগ দেয়া।
এখানে অভিভাবককে বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথম দায়িত্ব হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসার সময় তাঁকে তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমতঃ শিক্ষার্থী যে সুস্থ তা নিশ্চিত করতে হবে। জ্বর থাকলে তাকে প্রতিষ্ঠানে পাঠানো যাবে না। দ্বিতীয় হল মাস্ক পরিধানের বিষয়টি নিশ্চত করা। অতিরিক্ত একাধিক মাস্ক ও হ্যান্ডস্যানিটাইজার সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত,শিক্ষার্থীর জন্য নির্ধারিত এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চত করা।
শিক্ষার মূল লক্ষ্যের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া এসময় বেশি প্রয়োজন। জলবায়ু ও আবহাওয়া বোঝে ফসলের ধরন ঠিক করতে হয়। মাটির বুনট ও গুণাবলী বিবেচনা করে ফসল লাগাতে হয়, জমি তৈরি করতে হয়। তেমনি শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনেও মনে রাখা দরকার,শিক্ষার্থীকে কখনও শুধু জ্ঞানের ভাÐার করা শিক্ষার লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য হল, সেই অর্জিত জ্ঞানকে নিজস্বতায় আত্মীকরণ করে ধারণায় রূপ দেয়া। যাতে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমস্যা বোঝতে পারে, তা সমাধানে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং তা সমধানে সৃজনশীল চিন্তা করতে পারে। এর জন্য নাম্বার ভিত্তিক পরিমাপক মূল্যায়ন তথা প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি প্রধান অন্তরায় বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। সমস্যা চিহ্নিত করণ, সমাধানের বিভিন্ন উপায় খোঁজা, তার থেকে ভাল উপায়টি গ্রহণ করার সক্ষমতা প্রকাশ করতে পারা ইত্যাদির জন্য শিক্ষার্থীর সজীবতা কৌতুহল ইত্যাদি তার তাড়না হিসাবে কাজ করে। যদি কোভিড পরিস্থিতে আমাদের অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে, লেখা পড়ার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে,তাই লেখাপড়ায় ডুবে থাকতে হবে। এই সব তথ্য শিক্ষার্থীকে বার বার দিলে তার সীমাবদ্ধতা তার সামনে বিন্ধ্যাচলের মত পথ রোধ করে দাঁড়াবে। তার মনের সজীবতা কমে যাবে, জানার বা শেখার কৌতুহলও থাকবে না। ফলে শ্রেণিকার্যকমে যতই উপস্থিত থাকুক না কেন তা অর্থবহ হয়ে উঠবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এটাই হল বড় চ্যালেঞ্জ। এই কোভিড পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন ইতিবাচক প্রেক্ষাপট ও ইতিবাচক ঘটনার উদাহরণ দিয়ে উজ্জীবিত রাখা। যাতে কোভিডের ভয়াভহতায় জীবনবিমুখ চিন্তা না করে। হতাশা ও বিষন্নতা তাকে গ্রাস না করে। আমরা যদি এব্যাপারে সচেতন থাকি তা হলে শিক্ষার্থীমুখী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেল সহজ হবে। মনে রাখা জরুরি যে আমরা কোন শিক্ষাস্তর নিয়ে কাজ করছি তা মাথায় রাখা। মাধ্যমিক তথা নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য কোন নেতিবাচক সমালোচনা বিষয় প্রযোজ্য নয়। এই স্তরের শিক্ষার্থীর সামনে মানবিক বিষয়গুলোই আনতে হয়। কোভিড পরিস্থিতে অনেক মানবিক বিষয় ঘটেছে, পরিবার থেকে মানবতার পক্ষে কাজ করার জন্য ডাক্তারে বিদায় নেয়া এবং মারা যাওয়া। তাদেরকে শহীদের মর্যাদা দেয়া। হাসপাতাল থেকে এসে কোভিড পরিস্থিতিতে সন্তানকে বাড়ির বাউন্ডারির বাহির থেকে ডাক্তার বাবা একনজর দেখে চলে যাওয়া। সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মা সন্তানের মুখে মুখ দিয়ে ছুটে চলা। সারা জীবনের সঞ্চয় দশ হাজার টাকা কোভিড আক্রান্ত রোগীর সেবার জন্য ভিক্ষুকের দান করা ইত্যাদি মানবিক বিষয় সামনে আনা। শিক্ষার্থী তার আশেপাশের নানা ঘটনা ও বিষয় থেকে তার চেতনা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলে। তাই এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলার বড় চ্যালেঞ্জ হল শিক্ষার্থীর মূল্যবোধের ক্ষয় প্রতিরোধ করা। তাদের মানসিক সুস্থতা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলা হল শিক্ষকদের, অভিভাবকদের অন্যতম করণীয়। সে ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দেয়া ও দায়িত্বশীল হওয়ার এখনই সময়। কোভিড পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় আমাদের স্বোপার্জিত দক্ষতাগুলো কাজে লাগিয়ে করণীয়গুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। তবেই আমাদের কোভিড বিপর্যয়কালীন সকল সংকট ও চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে পারব। এতে শিক্ষার্থীদের তথা দেশের প্রজন্মদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজচিন্তক