কোভিড ডিউটি : মৃত্যুকূপে দাঁড়িয়ে…

14

 

বাংলাদেশে মার্চ ২০২০ শেষভাগে ১ম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। তখন করোনা মানেই আতংক, সাক্ষাৎ মৃত্যু। এমনকি করোনা সন্দেহে জ্বরের রোগী আলাদা ঘরে স্বজনহীন অবস্থায় চিৎকার করতে করতে মারা গেছেন; কেউ একটু পানিও দিতে সাহস করেনি। এমতাবস্থায় আমার ১ম কোভিড ডিউটি রোস্টার শুরু জুন ’২০-এ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মহোদয়ের স্বাক্ষরিত আদেশ; যেন মৃতুদÐাদেশ হাতে পেলাম। প্রচÐ ভয় পেলাম, মাথাটা একটু ঝিম করে ধরলো। চোখের সামনে ভেসে আসছে ইতালি, আমেরিকার মত উন্নত দেশেও কোভিড আক্রান্ত রোগীদের পরিনতি। নিজ কক্ষে এসে পিয়নকে ডেকে জল খেলাম। স্নায়ুবিক উত্তেজনায় হালকা ঘামও অনুভব করলাম। বাসায় এসে বাচ্চাদের বললাম। ছোট দুজন হাউমাউ কান্নাকাটি শুরু করে দিল। দৌঁড়ে গিন্নিও..। সবাই মিলে কিছুক্ষণ অঝোরে কাঁদলাম। একসময় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। গাইনী ডাক্তার বউ কাটাছেড়াও করে; ছোটখাট ব্রিফিং দিলো। সিদ্ধান্ত নিলাম, ডিউটি করবো। আমি কোভিডের ফ্রন্ট লাইনার। যুদ্ধের মাঠে ফ্রন্টলাইনার না থাকলে যুদ্ধ করবে কে? চিকিৎসক হিসাবে আমাদের দায়বদ্ধতা আছে, এই দায়বদ্ধতা থেকেই আজ পর্যন্ত ২০০জন ডাক্তার মারা গেছেন। ১ম ডিউটি জুন মাসে। বেড, ফ্লোর, করিডোর কোথাও খালি নেই। চোখের সামনেই শ্বাসকষ্টে রোগী মারা যাচ্ছে। নার্স-ডাক্তার জীবনের মায়া ছেড়ে দৌড়াচ্ছে রোগী বাঁচাতে। রোগী, স্বজনদের আর্তচিৎকার। বাঁচার করুণ আকুতি। সীমিত রিসোর্স নিয়ে চিকিৎসকদের অঙ্গীকার যুদ্ধ জয়ের। ২য় ডিউটি তাও ভয়াবহ, তবে কম। ৩য় ডিউটি (ফেব্রæয়ারি ২১), প্রায় স্বাভাবিক, অন্যান্য মেডিসিন ওয়ার্ডের মতো। ৪র্থ ডিউটি (২৯ এপ্রিল ২১) শেষ করলাম। অনেক রোগী; ১ম ডিউটির মতো… তবে আগের মতো মারাত্মক পর্যায়ের রোগী কম। কোভিড সন্দেহে রোগী ভর্তি হচ্ছে, অনেকের পজিটিভ; আবার অনেকের নেগেটিভ। পজিটিভ গতবার বয়স্কদের বেশী ছিলো, এবার অনেকে ৪০ এর নীচে; এমনকি শিশুও। টিকা দেওয়াতে এবার রোগের সিভিয়ারিটি কম হচ্ছে; করোনার বহুবার মিউটেশনও অন্যতম কারণ হতে পারে। ভয় পেলে চলবে না। এখনো মাস্ক, সোশ্যাল ডিস্টেন্স, সেনিটাইজার, সিম্পল এসবই আমাদের বাঁচাতে পারে কোভিডের মারাত্মক ঝুঁকি থেকে। আর চিকিৎসকদের ভাতা, প্রণোদনা!… থাক, এসব?… প্রশ্নবোধকেই থাক। সহকর্মী ডা. সামিউর, ডা. নজরুল ভাই, কিংবা অতি পরিচিত ডা. ললিত দা আছেন? নেই…..
বিশ্বাস তো হয় না,ওনারা কোভিড আক্রান্ত হয়ে আজ পরপারে।আমি তো সরাসরি কোভিড রোগীর সংস্পর্শে এসেও এখনো বেঁচে আছি পরম করুণাময়ের অপার কৃপায়। থাক না প্রণোদনা; বেঁচে থাকাটাই শ্রেষ্ঠ প্রণোদনা। একদিন ধরনী আবার স্বাভাবিক হবে…/আবার খোলামাঠে দাঁড়িয়ে গাইবো,/ ‘আমার সোনার বাংলা,/ আমি তোমায় ভালবাসি’।