কোনো দল-মত দেখা হবে না সবার জন্য কাজ করবো

56

দল-মত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের ভোটের মর্যাদা রক্ষা করে তাদের জীবনমান উন্নত করার জন্য প্রয়োজনে ‘বুকের রক্ত দিতে প্রস্তুত রয়েছেন’।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের সাফল্য উদযাপনে গতকাল শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের বিজয় সমাবেশে একথা বলেন শেখ হাসিনা।
নেতাকর্মীদের সতর্ক করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, বিজয় পাওয়া যত কঠিন, সেই বিজয় রক্ষা করে জনগণের সেবা করা আরো কঠিন কাজ। সেই কঠিন দায়িত্ব আমরা পেয়েছি। সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে সেটা সকলকে মনে করিয়ে দিতে চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু এই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উনয়ন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। জীবন দিয়েছেন আমার মা, আমার ভাইয়েরা। এই দেশের অনেক মানুষ জীবন দিয়েছে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে। সত্যিকার অর্থে সেই ভাগ্য পরিবর্তন যাতে ঘটে সেজন্য দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, প্রত্যেকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কাজ করে যাব। রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করে প্রত্যেকটা মানুষের জীবনমান উন্নত করব। সেখানে কোনো দল ও মত দেখা হবে না। প্রতিটি জনগণ প্রতিটি নাগরিক আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সেবা করার দায়িত্ব জনগণ আমাদের দিয়েছে।
নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন, আর যারা ভোট দেননি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বাস করে তাদের মূল্যবান ভোট দিয়েছে। এই ভোটের সম্মান আমি রক্ষা করব।
বাংলাদেশের মানুষের ভোটের মর্যাদা রক্ষা করে তাদের জীবনমান উন্নত করবার জন্য প্রয়োজনে আমি আমার বুকের রক্ত দিতে প্রস্তুত। সেই ওয়াদাই আজকে করে যেতে চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, গত নির্বাচনে জনগণ মাদকের বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। রায় দিয়েছে ক্ষুধামুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পক্ষে। জনগণের এই আকাক্সক্ষার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানান তিনি।
২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার পর থেকেই দেশজুড়ে জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান চালিয়ে আসছিল সরকার। এরমধ্যে গত বছর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শুরু হয় মাদকবিরোধী অভিযান।
নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূলের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধেও ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের মন্ত্রীরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে দেশের মানুষের যে আকাক্সক্ষা, সেটা পূরণ করা আমাদের কর্তব্য।
তিনি বলেন, অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রার রায় দিয়েছেন জনগণ। আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশের পক্ষে এ রায়। এ রায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি রায়।
জনগণ যে রায় দিয়েছেন সেখানে স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী তাদের কোনো স্থান হবে না। দুর্নীতিবাজ, জঙ্গিবাদ, মাদকের স্থান হবে না।
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৫৭টি আসনে জয় নিয়ে টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। ভোটের ১৯ দিন পর এই বিজয় উৎসব করল দলটি।
বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করেছি। ব্যক্তিগত জীবনের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি উৎসর্গ করেছি স্বজন হারানোর বেদনা নিয়েও।
যে বাংলাদেশে একটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে না, যে বাংলাদেশে একটি মানুষ গৃহহারা থাকবে না, যে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ চিকিৎসা পাবে, তরুণ সমাজের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে-সেই বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যের কথা জানান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
তিনি বলেন, জাতির পিতা স্বল্পোন্নত দেশ রেখে গিয়েছিলেন। আজকে বাংলাদেশ উনয়নশীল দেশ। এই উনয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব। সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় আগামীতে বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ এটাই আমাদের অঙ্গীকার এটাই আমাদের লক্ষ্য।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা চান চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া শেখ হাসিনা।
বেলা ৩টার পরপরই শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলে স্লোগানে স্লোগানে তাকে স্বাগত জানান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী সমর্থকরা।
উদ্যানের ভেতরে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার আদলে তৈরি করা হয় ‘বিজয় মঞ্চ’, তার পেছনের ব্যানার সাজানো হয় দলের এবারের ইশতেহারের মলাটের রঙে। বেঠাসহ ছোট বড় ৪০টিরও বেশি নৌকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ছবি সংবলিত ফেস্টুনে সাজানো হয় সমাবেশ মাঠ।
মঞ্চে শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, ফারুক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, দীপু মনি প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের নেতা ও মন্ত্রিপরিষদের বেশিরভাগ সদস্য মঞ্চে ছিলেন। খবর বিডিনিউজের
জনসভার কারণে সকাল ১১টা থেকে শাহবাগের রূপসী বাংলা সিগন্যাল, কাঁটাবন মার্কেট মোড়, নীলক্ষেত মোড়, চানখাঁরপুল, জিপিও ও মৎস্য ভবন মোড় থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানমুখী সব রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
জনসভায় যোগ দিতে সকাল ৯টায়ই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অভিমুখী মিছিল দেখা যায় ঢাকার নানা স্থানে। বাংলা একাডেমির বিপরীত দিক দিয়ে উদ্যানে ঢোকার পথে ছিল দীর্ঘ সারি।
‘জয় বাংলা’ স্লোগানের সঙ্গে ঢাক-ঢোলের বাদ্যে মুখর নেতা-কর্মীদের দুপুরে মাতিয়ে তোলেন জনপ্রিয় সব সঙ্গীত শিল্পী।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী রফিকুল আলমের পাশাপাশি কণ্ঠ মেলান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া মমতাজও। এছাড়াও গান গেয়ে শোনান ফকির আলমগীর, জানে আলম, পথিক নবী, আঁখি আলমগীর ও সালমা। ব্যান্ড দল জলের গানও তাদের পরিবেশনা নিয়ে আসে এই উৎসবে।
গানে গানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বন্দনা যেমন ছিল, তেমনি ছিল গত এক দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের কথাও।
সমাবেশে আ.লীগ নেতারা যা বললেন :
বিজয় উৎসবে গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতারা একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার অবদানের কথা স্বীকার করেন। তারা বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আস্থা রেখেছে দেশের মানুষ। তাদের অকুণ্ঠ সমর্থনেই তিনি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আর শেখ হাসিনা এখন বিশ্ব নেতৃত্বের কাতারে শামিল হয়েছেন।
সমাবেশে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের আকাক্সক্ষা নিয়ে মানুষ এবার নৌকায় ভোট দিয়েছে। নতুন আলোর দিন উপহার দেওয়ার জন্য এ বিজয় উপহার দিয়েছে।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, এবারের বিজয় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মানবতার বিজয়। গ্রামের যে শিশুটি বছরের প্রথম দিন নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে, এই বিজয় তার বিজয়। ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে সমুদ্রের পানিতে নিক্ষেপ না করে মায়ের মমতা দিয়েছেন যিনি, সেই মানবিকতার বিজয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ভেঙে জনতার বিজয়।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা তোফায়েল আহমেদ বলেন, পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা বলেন, তারা বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে চান। আজ বাংলাদেশ সারা বিশ্বের মডেল।
দলের আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু বলেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে যদি মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকে। এ দেশের মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়ার জন্য অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ১৯ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে শেখ হাসিনা লড়াই করে যাচ্ছেন।
আমু বলেন, ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন শুরু করেছিলেন। এখন বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে। শেখ হাসিনার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মো. নাসিম, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান প্রমুখ।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের আগে নির্বাচনে বিজয়ে শেখ হাসিনার উদ্দেশে লেখা অভিনন্দনপত্র পড়েন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সেখানে তিনি বলেন, মৃত্যুর মিছিলে আপনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান। কথা দিয়ে কথা রাখার রাজনৈতিক সংস্কৃতি আপনি ফিরিয়ে এনেছেন।
কাদের বলেন, জনগণ রায়ের মাধ্যমের প্রমাণ দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশের পক্ষে। শুধু রাজনৈতিক নেতা নন, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনা আজ বিশ্ব নেতৃত্বের কাতারে।
সভা পরিচালনা করেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।