কোথায় সেই ঈমানী চেতনা

5

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘রেহ গিয়া রছ্মে আজাঁ রুহে বেলালী না রেহি’ / ফলসাফা রেহ গিয়ি তালকিনে গায্যালী না রেহি ’। / আযান প্রথা আছে কিন্তু সেই বেলালী চেতনা এখন নেই। দর্শন আছে কিন্তু ঈমাম গায্যালী (রা.)’র শিক্ষা এখন আর নেই। জজিরাতুল আরব (আরব উপদ্বীপ) আছে, কিন্তু সেই মুসলিম খলিফাদের আদর্শ ও শাসন এখন নেই। নেই তাদের বিচার। নেই তাদের চেতনা। বিচারের বাণী আজ নিরবে নিভৃতে কাঁদে। অভিশপ্ত জাতি বনি ঈ¯্রাইল বা ইহুদীর অবস্থা হয়েছে আজ আমাদের। ইনসাফ আজ উধাও হয়েছে মুসলিম জাহানের বহু দেশ থেকে। দুঃখের সাথে স্বীকার করতে হয় মুসলিম জাহানের সাতান্নটি দেশের একটিতেও মুসলিম খলিফাদের গড়া মদীনায়ে তাইয়্যেবার সেই আদর্শ পাওয়া যাবে না ; একটি সমাজকেও পাওয়া যাবে না সেই সমাজের অনুরূপ। ব্যক্তিগত জীবনের কথা বললে সেখানে নিরাশ হতে হবে আরও বেশি।
চরিত্র বলতে আমাদের গর্ব করার মত কী আছে ? সবখানে ধোঁকা, সবখানে প্রতারণা, বেঈমানী, মোনাফেকী, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, শঠতা, জালিয়াতি, জোচ্চুরি সবখানে, সর্বমহলে সর্বত্র। বিদায় নিয়েছে বিশ^াস, বিদায় নিয়েছে সততা, আমাতদারি। হাট-বাজারে, অফিস আদালতে, রাস্তা-ঘাটে, সমাজে-সভায়, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায়। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত, ধনী-গরীব, কুলীন অকুলীন সবখানেই বিশ^াসহীনতা। সবখানেই ইয়ানফ্সী ইয়ানফ্সী অবস্থা। সুযোগ পেলেই স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা, সুযোগ পেলে পরের মাথায় কাঠাল ভেঙে খাওয়ার মানসিকতা আমাদের ক্রমেই মানুষ পদবাচ্যের অযোগ্য করে তুলেছে। দারিদ্য, অভাব, অনটন, অপচয় অপব্যয়, বিলাসিতা; উচ্ছৃঙ্খলতা, স্বেচ্ছাচার দিন দিনই বাড়ছে। বাড়ছে জুলম অন্যায়, বাড়ছে অশান্তি উদ্বেগ, বাড়ছে পাপ-পঙ্কিলতা। অথচ আমরা গর্বের সাথে দাবি করি আমরা মহানবী (দ.)’র উম্মত, খোলাফায়ে রাশেদীনের অনুসারী সৃষ্টির সেরা জাতি ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। আমরা পৃথিবীর মুসলমান সমাজের প্রতি দৃষ্টিপাত কবলে দেখি কোন দেশের অবস্থা তেমন ভালো নেই। কেন এমন হলো, আমরা তো সৃষ্টির সেরা সুন্দরতম প্রিয় নবী (দ.)’র উত্তম আদর্শের অনুসারী।
আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের ইজ্জত রক্ষার গ্যারান্টি দিতে হবে অন্যদের। ধনী হয়েও আমরা কাঙাল, প্রাচুর্য্যরে অধিকারী হয়েও পরমুখাপেক্ষী। আমাদের প্রথম কেবল বায়তুল মোকাদ্দেসে ইহুদীদের অবস্থান, আমাদের দেশে দেশে আগুন জ¦লছে। মা-বোনরা লাঞ্ছিত হয়, যুবকদের বুকের খুন ঝরে, শিশুদের বুকের পাঁঁজরের উপর দিয়ে বিজাতির বুল ডোজার চলে, মজলুমদের অর্থ হাহাকারে দুনিয়ার বাতাস ভারি হয়ে উঠে। গৃহে গৃহে আগুন জ¦লে। নিজ বাস্তুভিটা থেকে লাখ লাখ ছিন্নমূল হয়ে মরু বিয়ানে মাত্র বেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।
অথচ আজকের মুসলিম জাহানের রাজা বাদশাহরা তাঁদের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছে তাদের বিলাস বহুল জীবন যাপনে। তারা ভুলে গেছে পরকালের কথা। তারা মনে করছে এ পৃথিবীতে বসবাস স্থায়ী হবে। তারা আরো ভুলে গেছে খলিফাতুল মোসলেমিন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আমিরুল মোসলেমিন হযরত ওমর(রা.) হযরত ওসমান (রা.) হযরত আলী (রা.) ও ইতিহাসের দ্বিতীয় ওমর হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের রাষ্ট্র শাসন ও আদর্শের কথা। মনে রাখা উচিৎ ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)’র বেতন ধার্য দিল আড়াই হাজার দিরহাম। অথচ তিনি লক্ষ লক্ষ দিরহাম পবিত্র ইসলামের জন্য রাসুল (দ.) এর হাতে বা বায়তুলমালে দান করেছিলেন। এই অল্প ভাতায় খুবই অনাড়ম্বরভাবে দিন কাটছিলো মুসলিম জাহানের খলিফার।
পরিবারের লোকজন বহুদিন ধরে উত্তম খাদ্য খেতে পারেননি। বহুদিন ধরে তাঁর ঘরে মিষ্টি জাতীয় একটু খাবারও তৈরী হয়নি। অথচ রাষ্ট্র শাসনের পূর্বে প্রায়ই তাঁর ঘরে উন্নতমানের খাবারের আয়োজন থাকতো। তাই খলিফার ছেলে মেয়ে তাদের মায়ের কাছে আবদার করছেন একটু মিষ্টি তৈরি করতে। বারবার অবদার শুনে সন্তানদের মা ঘরে কিছু মিষ্টি তৈরির ইচ্ছা করলেন, এবং হযরত আবু বকর (রা.)’র কাছে সামান্য অর্থ চাইলেন। জবাবে, খলিফা বললেন, মিষ্টি তৈরির জন্য দেওয়ার মতো অর্থ আমার নেই। পারিবারিক খরচের জন্য যা পাই তা তো যথাসময়েই তোমার হাতে এনে দিই। কিছুদিন পর খলিফার স্ত্রী কিছু খাদ্যদ্রব্য তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, এইগুলো দিয়ে বাজার হতে কিছু মিষ্টি এনে দিন আমাদের জন্য। খাদ্যদ্রব্যগুলো দেখে খলিফা স্ত্রীকে জিজ্ঞ্যাস করলেন, ‘খাদ্যদ্রব্যগুলো কোথায় পেলেন ? স্ত্রী বললেন, ‘দৈনন্দিন খাদ্য হতে কিছু সঞ্চয় করেছিলাম। এই কয়েকদিনে কিছু সঞ্চিত হয়েছিল। খলিফা বাইতুল মালের কোষাধ্যক্ষকে ডেকে এনে নির্দেশ দিলেন সঞ্চিত খাদ্যদ্রব্য বাইতুলমালে জমা করতে এবং খলিফার বেতন কমিয়ে দিতে, যাতে খাদ্য সঞ্চয়ের মতো অর্থ না থাকে তাঁর কাছে। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মুসলিম জাহানের খলিফা ছিলেন। দুনিয়া হতে খলিফার শেষ বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। একদিন তিনি কন্যা আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) কে বললেন, আমি এযাবৎ বায়তুলমাল হতে কতো দিরহাম গ্রহণ করেছি তা হিসেব করো। আয়েশা হিসেব করে বললেন, সর্বমোট ৬ হাজার দিরহাম। খলিফা আয়েশাকে নির্দেশ দিলেন, আমার জমি বিক্রয় করে বায়তুলমালের এই অর্থ ফিরিয়ে দাও। খলিফার নির্দেশ পালন করা হলো। খলিফা আবু বকর (রা.)’র খেলাফত কালে যে ৬ হাজার দিরহাম গ্রহণ করেছিলেন ওফাতকালে তাও ফেরত দিয়ে গেলেন।
জ্ঞানি লোকেরা ভালো করে জানে যে, ইসলামী ইতিহাস ধ্বংস হয়ে যায়নি। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.)’র আমলে মুসলিম সেনা বাহিনী জেরুজালেম অবরোধ করেছিলেন। নগরীর পৌত্তলিক অধিবাসীরা উপায়ান্তর না দেখে আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিলো। তবে তারা শর্ত আরোপ করলো যে, খলিয়া স্বয়ং উপস্থিত হতে হবে এবং শুধু তাঁর হাতেই নগরীর চাবি অর্পণ করেব। বিজয়ী মুসলিম বাহিনীর শক্তি সামথ্য থাকা সত্তে¡ও জোরপূর্বক নগরীতে প্রবেশ করার পরিবর্তে খলিফার কাছে সংবাদ পাঠালো। সংবাদ পেয়ে খলিফা ওমর (রা.) উষ্ট্রপৃষ্ঠে আরোহন করে জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হলেন। উষ্ট্রের রশি টেনে ছিলেন তার ভৃত্য। খলিফা অর্ধপথ অতিক্রম করেলে উষ্ট্র হতে মেনে গেলেন এবং তাঁর ভৃত্যকে উষ্ট্রারোহী করলেন। অবশিষ্ট পথ উষ্ট্রের রশি ধরে টেনে নিলেন জেরুজালেমে হযরত ওমর ফারুক (রা.) জেরুজালেমবাসী স্বাগত জানালো উষ্ট্রারোহীকে। খলিফার ভৃত্য হযরত ওমর (রা.)’র পরিচয় দিলে জেরুজালেমবাসী বিষ্মিত হলেন। তারা খলিফার কাছে তার কারণ জানতে চেয়ে বললেন, আপনি একজন মহান নেতা, কেন উষ্ট্রারোহী হলে আসলেন না ? উত্তরে তিনি বললেন, সারাপথ একজন লোক হেঁটে আসা বা উটের রশি টেনে আসা অপর জন উষ্টপীঠে সওয়ার হয়ে আসা পবিত্র ইসলামের বিধান নয়। পৌত্তলিকরা খলিফার কথা শুনে তাঁর হাতে নগরীর চাবি সমর্পন করে। বিজয়ী মুসলিম বাহিনীকে পৌত্তলিকদের জানমাল ও ধর্মীয় স্থানের হেফাজত করার নির্দেশ দিয়ে খলিফা রাজধানীতে ফিরে গেলেন। পৌত্তলিকরা মুসলমানের উদারতায় মুগ্ধ হলো।
লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক