কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের খাত নিয়ে নির্বিকার চসিক

133

নগরীরতে দেয়াল, বিদ্যুতের খুঁটি বা যে কোনো দন্ডায়মান বস্তুÑসব জায়গায় ব্যানার-পোস্টারের ছড়াছড়ি। বাদ যায় না ‘ব্যানার-পোস্টার লাগানো নিষেধ’ লেখা দেয়ালগুলোও। এ যেন অন্যের দেয়ালে আপন খেয়ালে রঙ-তুলির ছোঁয়ায় কিংবা প্রযুক্তির কল্যাণে মুদ্র্রিত রঙ-বেরঙের পোস্টার সেঁটে নিজের বা প্রতিষ্ঠানের সাফাই গাওয়ার উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম।
অথচ নগরীর যে কোনো স্থানে পোস্টার লাগাতে হলে সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি নিতে হয়। এটা আইন। সিটি কর্পোরেশন সংক্রান্ত বাংলাদেশ গেজেটে উল্লেখ আছে, বড় পোস্টারের জন্য প্রতিদিন ১০ টাকা, ছোট পোস্টারের জন্য প্রতিদিন ৭ টাকা, ক্যানভাস কাঠের ফ্রেমে প্রতিমাসে ৩ হাজার টাকা, ফেস্টুন বা ব্যানারের জন্য প্রতি ১৫ দিনে ৫শ টাকা করে কর প্রদান করতে হবে। এছাড়াও অবাণিজ্যিক তোরণ বা গেটের জন্য প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা এবং বাণিজ্যিক তোরণের জন্য প্রতিমাসে ২০ টাকা কর প্রদান করার আইন রয়েছে।
নগরীর দেয়ালে-খুঁটিতে প্রতিদিন যে পরিমাণ পোস্টার-ব্যানার সাঁটানো হয় তা থেকে রাজস্ব আদায় হলে তার পরিমাণ নিঃসন্দেহে প্রতি মাসে কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেত। কিন্তু কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের এ খাত নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা-ই নেই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক)। এমনকি ব্যানার-পোস্টার লাগানো অনুমতি প্রদান বা কর আদায় কোনোটির চর্চা কর্পোরেশনে হয় না। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এমনটা জানা গেছে।
গত কয়েকদিন ধরে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, শহরের খুব কম দেয়ালই আছে যেখানে পোস্টার নেই। তবে সবচেয়ে বেশি পোস্টার রয়েছে বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেন, কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের। নগরীর চকবাজার এলাকায় ব্যানার-পোস্টার লাগানোর বিষয়টি রীতিমত নির্যাতনের পর্যায়ে চলে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন ভবনের মালিকেরা। এমনকি চট্টগ্রাম কলেজের সীমানা প্রাচীর থেকে গেটের কোনো অংশই খালি নেই। পুরো দেয়ালটি দখল করে রেখেছে রং বেরঙের পোস্টার।
সিটি কর্পোরেশন শুধু রাজস্ব হারাচ্ছে তা নয়, যত্রতত্র ব্যানার-পোস্টারের কারণে রীতিমত শ্রীহীন হয়ে পড়ছে নগরী। চট্টগ্রামে প্রায় ৫শ’র মত ছাপাখানা (প্রেস) রয়েছে। চট্টগ্রাম প্রেস মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন শুধুমাত্র নগরীর স্কুল, কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের লক্ষাধিক ব্যানার-পোস্টার ছাপানো হয়। তবে মৌসুম অনুযায়ী এ সংখ্যা বাড়ে কমে বলে জানা গেছে। ব্যানার-পোস্টার রাতের আঁধারে সেঁটে দেয়া হয় নগরীর এ দেয়াল থেকে সে দেয়ালে।
জানা গেছে এসব ব্যানার-পোস্টার লাগানোর কাজ করে একটি সিন্ডিকেট। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্ডার নিয়ে যেখানে সেখানে পোস্টার লাগায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ কাজে নগরীতে প্রায় শতাধিক এলাকাভিত্তিক গ্রæপ রয়েছে। তারা ব্যানার-পোস্টার লাগানোর কাজ করে। সাধারণত তারা প্রতিটি পোস্টার লাগাতে আড়াই থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের লোক দিয়েও লাগিয়ে থাকে।
দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণকল্পে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২ প্রণয়ন করে। এ আইনে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ বিধান লঙ্ঘন করলে শাস্তি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ১০ হাজার এবং অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদÐের বিধান রাখা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, কোনো সুবিধাভোগীর অনুকূলে বিধান লঙ্ঘন করে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো হলে ওই সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন ১০ হাজার ও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদÐ আরোপ করা যাবে এবং অনাদায়ে ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদÐ দেওয়া যাবে। বিচারের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘন করার অভিযোগ পাওয়া গেলে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ অনুযায়ী বিচার হবে। সুবিধাভোগীর ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া গেলে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার হবে। কোনো কোম্পানি যদি এ আইন লঙ্ঘন করে তবে ওই কোম্পানির প্রত্যেক পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী এ অপরাধ সংঘটিত করেছেন বলে ধরা হবে। বিদ্যমান আইনের বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন পরিচালিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ কোনো স্থানীয় নির্বাচনে, নির্বাচনী প্রচারণাসংক্রান্ত দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধান এবং এ উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারি করা নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, অন্য কোনো নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প‚র্বানুমোদন নিয়ে অনুমোদিত স্থানে নির্ধারিত শর্তে নির্বাচনী প্রচারণাসংক্রান্ত দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, নির্বাচন শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে ওই দেয়াল লিখন বা পোস্টার অপসারণ করতে হবে। এ আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী বিদ্যমান দেয়াল লিখন বা পোস্টার মুছে ফেলা ও অপসারণের জন্য সরকার গেজেটের দ্বারা সময়সীমা নির্ধারণ করে দেবে এবং ওই সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তা অপসারণ ও মুছে ফেলতে হবে। যদি এ সময়সীমার মধ্যে তা অপসারণ না করা হয় তবে সময় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তা অপসারণের ব্যবস্থা নেবে এবং এর জন্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ের সমুদয় অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সুবিধাভোগীর কাছ থেকে আদায় করতে পারবে।
এ বিষয়ে চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবু শাহেদ চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ব্যানার -পোস্টার লাগাতে গিয়ে সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি নেয় কি না সে বিষয়ে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। কেননা আমি সিটি কর্পোরেশনে এসেছি বেশিদিন হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে। আমি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা নিব।
মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, আমাদের শহরে এ বাজে অভ্যাসটি অনেকদিন ধরে চলে আসছে। সেটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমরা শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছি আর সেখানে তারা অপরিষ্কার করে রাখছে। এভাবে ভালো কাজের প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে নিরুৎসাহিত হয়।
মেয়র আরও বলেন, আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হচ্ছে। কিন্তু সে অনুপাতে আমাদের মন-মানসিকতা উন্নত হচ্ছে না। ফলে আমরা যা তা-ই থেকে যাচ্ছি। উন্নত বিশ্বের কেউ এসে যদি নগরীর এসব চিত্রে দেখে, তাহলে আমাদের ভাবমূর্তি কোথায় যায়-সেটা যদি তারা চিন্তা করত।
তবে নগরবাসীর প্রতি আহŸান থাকবে, আমরা আইনকে শ্রদ্ধা করি, শহরটাকে পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করি। শুধু নিজেরা পোস্টার-ব্যানার লাগানো থেকে বিরত থাকলে হবে না, অন্য কেউ লাগালে সেখানে প্রতিবাদ করতে হবে।