কেজিডিসিএলের ১ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা মুনাফা

19

মনিরুল ইসলাম মুন্না

গ্যাস সংকটের কারণে পোশাক কারখানা থেকে শুরু করে জাহাজ ভাঙা শিল্পসহ নগরীর ছোট-বড় প্রায় ১২শটি শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকের কম গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছেন তারা। ছোট-বড় প্রায় ১২শটি শিল্প কারখানার অবস্থা একই রকম। ফলে চট্টগ্রামের ইস্পাত শিল্প, জাহাজ ভাঙ্গা, পোশাক, সার কারখানা, সিরামিক, স্টিল পণ্যসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এরই মধ্যে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ৪ হাজার ৭৯০ কোটি ৮ লাখ টাকার গ্যাস বিক্রি করে ১ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে ৮৫৯ কোটি টাকা। আর বকেয়া বাবদ আদায় করেছে ১ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। চট্টগ্রামে গত অর্থবছরে এলএনজি থেকে বেশি গ্যাস ব্যবহার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গ্যাস বিক্রি হয়েছে সার কারখানায়। এ খাতে ২ হাজার ২৪ দশমিক ৭৭ কোটি টাকার গ্যাস বিক্রি করা হয়েছে।
এদিকে কারখানা মালিকরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণে যে লোকসান হচ্ছে, তাতে তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্যই লড়াই করতে হচ্ছে। শুরুতে করোনার কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এরপর ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণেও ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। গ্যাসের সংকট এই ক্ষতিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, বর্তমানে আমরা কম উৎপাদনে যাচ্ছি। তার মধ্যেও ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ খরচ বেশি পড়ছে। প্রতিদিন গড়ে চার ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এ কারণে আমাদের কাজের কর্মপরিধিও কমেছে। জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন করতে গেলেও খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা ১০ ঘণ্টা উৎপাদনের সময় কমিয়ে ৮ ঘণ্টা চালাই।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের উৎপাদন কম বলে বিভিন্ন দেশে কম রপ্তানি করছি। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি মন্দা চলছে। তবে কিছুদিনের মধ্যে তা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বাইয়াররা দেশে আসবেন এবং অর্ডার দিবেন। তাই এর আগেই আমাদের সবকিছু স্বাভাবিক করা উচিত।
গ্যাস সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রামের শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু গ্যাস-সংকটের কারণে চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে বিরাজমান সংযোগ ও অপেক্ষমাণ সংযোগের চাহিদা রয়েছে দৈনিক প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, চট্টগ্রামে চাহিদার অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। পুরোপুরি গ্যাস সরবরাহ করা গেলে বর্তমানের দ্বিগুণ রাজস্ব আয় হতো। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থাৎ গত জুন মাস পর্যন্ত তিন হাজার ১৫৭ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস বিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তার বিপরীতে বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৯৫ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস। অর্থাৎ গত অর্থবছরে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকার গ্যাস বিক্রি করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গ্যাস বিক্রি হয়েছে সার কারখানায়। এ খাতে ২ হাজার ২৪ দশমিক ৭৭ কোটি টাকার গ্যাস বিক্রি করা হয়েছে। শিল্প খাতে (বৃহৎ) গ্যাস বিক্রি হয়েছে ৫৮০ কোটি ২৬ লাখ টাকার। ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পকারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ক্যাপটিভ পাওয়ার রয়েছে। ক্যাপটিভ পাওয়ার খাতে গ্যাস বিক্রি হয়েছে ৭৩২ কোটি ৩২ লাখ টাকার। আবাসিক খাতে গ্যাস বিক্রি হয়েছে ৬৭৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকার। সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস বিক্রি হয়েছে ৪৭০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার। গ্যাস সংকটের কারণে বছরের অধিকাংশ সময় গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ ছিল। ফলে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস বিক্রি হয়েছে ২৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
গত অর্থবছরে কোম্পানি গ্যাস ক্রয় করেছে ৩ হাজার ৬২ দশমিক ২২ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন গ্যাসক্ষেত্র থেকে ১০ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ঘনমিটার আর এলএনজি থেকে ৩ হাজার ৫২ দশমিক শূন্য ৪ মিলিয়ন ঘনমিটার।
জানা গেছে, গত ২০১৫ সাল থেকে আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান বন্ধ রয়েছে। ফলে এই বছরে নতুন সংযোগ দেওয়া হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৬টি, শিল্প খাতে ১৬টি, ক্যাপটিভ পাওয়ার খাতে চারটি ও বাণিজ্যিক খাতে তিনটি। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে মোট সংযোগ রয়েছে ৬ লাখ ১ হাজার ৭০৩টি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত অর্থবছরে বকেয়ার জন্য ১ হাজার ৮৭৮টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আর অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ৯২টি। তার বিপরীতে পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৫৫৯টি।
তবে অভিযোগ রয়েছে নগরীতে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে গ্যাস চুরি হচ্ছে। আবাসিক খাতে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বেশি গ্যাস চুরি হচ্ছে। কিন্তু সেই পরিমাণে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে অভিযান হয়নি। কার্যকর অভিযান চালানো গেলে আরো বেশি গ্যাস চুরির সন্ধান পাওয়া যেত।
কর্মকর্তারা জানান, সরবরাহ করা গ্যাসের চুরি বন্ধে কোম্পানির সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ৪ লাখ ৩৫ হাজার আবাসিক সংযোগে প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হবে। বর্তমানে প্রথম দফায় ৬০ হাজার আবাসিক গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, গ্যাসের যেমন সাশ্রয় হয়েছে তেমনি চুরিও বন্ধ হয়েছে। এতে গ্রাহক ও কোম্পানি উভয়ে লাভবান হয়েছে। এখন দ্বিতীয় দফায় আরো ১ লাখ গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। যা আগামী বছরের জুনের আগে স্থাপনের কাজ শুরু হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহা-ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মু. রইস উদ্দিন আহমেদ পূর্বদেশকে বলেন, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সবসময় লাভেই থাকে। বকেয়া টাকা আদায় করে লাভে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে আমরা মাত্র ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট বা চাহিদার ৪৪% যোগান দিতে পারছি। গ্যাস সংকট থাকায় তার বেশি দিতে পারছি না। আমদানি বা উৎপাদন বাড়লে আমরা গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক করতে পারব।