কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্রোগ্রামিং ও আমাদের নতুন প্রজন্ম

27

শেখ বিবি কাউছার

বর্তমানে আমরা এমন এক সময়ের মুখোমুখি যেখানে প্রযুক্তিবিহীন জীবন কল্পনা করা কঠিন। সে প্রযুক্তির নানান বিষয়ের সাথে নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলা এখন সময়ের দাবি। বর্তমান সময়ে আলোচিত বিষয়ের মধ্যে অন্যতম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল মেশিন দ্বারা প্রদর্শিত বুদ্ধি। মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন হয়ে উঠেছে একটি একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্র যেখানে পড়ানো হয় কিভাবে কম্পিউটার এবং সফটওয়্যার তৈরি করে বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করতে হয়। এটি দিন দিন আমাদের জীবনে কি যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা করোনা মহামারি বুঝিয়ে দিয়েছে। বাইরের দেশগুলো (চীন, জাপান, কোরিয়া, আমেরিকাসহ আরো অনেক দেশ) অনেক আগে থেকেই রোবট প্রযুক্তির সাথে পরিচিত। কারণ আগামী বিশ্বে নেতৃত্বে জায়গা করে নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাংলাদেশও কিন্তু প্রবেশ করেছে রোবটিক্সের জগতে। আর রোবটিক্সের মূল ভিত্তি প্রোগ্রামিং। তাই শিশু-কিশোরদের কোডিং বা প্রোগ্রামিং শেখানো অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তি বিষয়ে এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের রয়েছে প্রচুর আগ্রহ। তবে আশার কথা আমাদের দেশেও এই শব্দটি বেশি শোনা যাচ্ছে বেশ কয়েক বছর থেকে। আর কোভিড-১৯ আসার পর এর গুরুত্ব ও চাহিদা বেড়ে গেছে বহুগুণ। বাইরের দেশগুলো রোবটের মাধ্যমে রোগীর সেবাশুশ্রæষা থেকে শুরু করে শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক উপকার পাচ্ছে। এমনকি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করছে উড়ন্ত ড্রোন। আর ইতিমধ্যে ড্রাইভারবিহীন গাড়ি বা স্বচালিত বাস কোরিয়ার রাস্তায় চলাচল শুরু করেছে। আর মানুষের মস্তিষ্কে যন্ত্র (নিউরালিংক)বসানোর পরীক্ষায় নামছেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক।
আমরা হয়তো চিন্তা করছি, এগুলো আমাদের এখানে আসতে আরো সময় লাগবে। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন, যখন বাইরের দেশে এ্যান্ডয়েড ফোন চালু হল তখন আমাদের কাছে এটি কাল্পনিক গল্পের মতো মনে হতো যে ফোনে কিভাবে সেলফি তোলে, কিভাবে মুহূর্তের মধ্যে ভিডিওকল ও মেসেজ পাঠায় হয় আরো কত কি! আর এখন এ্যান্ড্রয়েড সেট প্রায় সবার ঘরে ঘরে। এখন যেমন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে ঠিক সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে, এখন আমাদের যে নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে তাদেরকে আমরা প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে পারবো না।কারণ তারা প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকা মানে নিজেকে ও দেশকে পিছিয়ে রাখা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম- ২০২১ এর রিপোর্ট বলছে, প্রচুর মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে ঠিক, তেমনি প্রচুর নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে। আমরা অনার্স-মাস্টার্স করার পেছনে ছুটি কিন্তু কয়জনইবা পলিটেকনিক কিংবা কারিগরিতে পড়তে চায়? এগুলো যায় কোথাও ভর্তির সুযোগ না পেয়ে। কিন্তু সেখানে কাজের সুযোগ আছে অনেক বেশি। আপনি দিনমজুরের কাজ বলেন আর পোশাক শ্রমিকের কাজই বলেন, এই জায়গাগুলোতে যত বেশি অটোমেশন হবে, তত শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাবে। তাই এখন থেকে আগামী প্রজন্মকে প্রস্তুত করতে হবে সেভাবে। আগামীর প্রজন্মকে দক্ষ করে তুলতেই হবে। অটোমেশন হলো মানুষ আর রোবটের সমন্বয়ে কাজ। অর্থাৎ পুরো কাজটাই রোবট করবে না; বরং মানুষ ও রোবটের পারস্পরিক সহায়তায় কাজ হবে, যাকে বলা হয় কোবট বা কলাবরোটিভ রোবট। রোবট যে কাজগুলো করছে, সেগুলোকে অপারেট করতে লাগবে দক্ষ মানুষ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যারা এখন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে তাদেরও কারিগরি দক্ষতার উপর জোর দিতে হবে।
শুধুমাত্র সার্টিফিকেট কিংবা জিপিএ ৫ দেখে চাকরি পাওয়ার সময় কিন্তু শেষ। খুব শিগগির দক্ষতাই হবে যোগ্যতার মাপকাঠি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা বা জিপিএ ৫ পাওয়া জীবনের মূল উদ্দেশ্য নয়। এই ধ্যান ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি কোনো না কোনো বিষয়ের উপর দক্ষতা অর্জন করতেই হবে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ আয়োজন করেছিল ‘বিশ্বকাপ’ আন্তর্জাতিক কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা (আইসিপিসি)। উল্লেখ্য জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী সর্বপ্রথম এটি আয়োজন করার কথা ভাবেন। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশও অংশগ্রহণ করে। তবে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল মোটামুটি পর্যায়ে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা অনেক মেধাবী। কিন্তু অনেক সময় সুযোগ সুবিধার অভাবে তারা এগুতে পারে না। এই প্রসঙ্গে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক এম কায়কোবাদ স্যারের মতামত ছিল ‘তিন-চার দিন আগে থেকেই আমরা জানি ঢাকায় চ‚ড়ান্ত পর্ব হতে যাচ্ছে। আমাদের উচিত ছিল শিক্ষার্থীদের তৈরি করা, তাদের পেছনে বিনিয়োগ করা। এটার জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি লাগে। অল্প কিছুদিন প্রশিক্ষণ দিয়ে ভালো ফলাফল আশা করা যায় না।’ যখন এই বিশ্বকাপ প্রোগ্রামিং অনুষ্ঠিত হয় তখন অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে পেশাগত জীবনে ঢুকে যান। যার ফলে একসঙ্গে দলের অনুশীলন করা হয়ে উঠে না। রাশিয়া, চীনের প্রতিযোগিদের অনেকই আছেন, যাঁরা সারা দিন এটা নিয়েই থাকেন।
নতুন প্রজন্মের চিন্তা ভাবনায়, ধ্যান ধারণায় এখন থেকে ঢুকিয়ে দিতে হবে যে, তোমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করবে মানুষের উপকারে,অপকারে নয়।কারণ আগামী দিন গুলোতে শতভাগ কাজ চলে যাবে প্রযুক্তির হাতে সেটা সেবামূলক হোক কিংবা চাকরি। আবার শুধুমাত্র প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হলে চলবে না, প্রযুক্তি তৈরিতোও আমাদের দক্ষ হওয়া চাই। কারণ প্রযুক্তির প্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিস আমাদের চীন,জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। নতুন প্রজন্মকে ভিডিও ও মোবাইল গেইম এর আসক্তি হতে দূরে রাখতে তাদেরকে মজার,মজার কার্যকলাপের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।তাই এখন থেকেই কম্পিউটিং, প্রোগ্রামিং আর রোবটিক্স শেখার প্রতি তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে তারা লাইকি, টিকটক, কিংবা পাপজির পেছনে সময় নষ্ট করবে না। ইতিমধ্যে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা এগুলো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। প্রচুর সময় নষ্ট করছে এগুলোর পেছনে। এ অ্যাপগুলোর মাত্রারিক্ত ব্যবহার তাদের সৃজনশীলতা নষ্ট করে দিচ্ছে। শিক্ষার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায় না বলে সৃষ্টি হচ্ছে কিশোর গ্যাং।
বিল গেটসের কথাই ধরি, যখন তিনি ক্লাস এইটের ছাত্র তখন স্কুলের কম্পিউটার ক্লাব থেকে তার প্রোগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি। গেটসের ভাষ্যমতে, এমন একটি সপ্তাহও যায়নি যখন অন্তত ৩০ ঘন্টা ঐ কম্পিউটার রুমে তিনি কাটান নি।মানে প্রতিদিন কম পক্ষে ৪ ঘন্টা। আর আমরা কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের কথা শুনছি সবচেয়ে বেশি গত কয়েক বছর থেকে। অথচ বিল গেটস সেই ১৯৭১ সালেই সাত মাসে ১,৫৭৫ ঘন্টা ব্যয় করেন কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের পেছনে। হার্ভার্ডের স্নাতক পড়া মাঝপথে তিনি যখন ছেড়ে দিলেন তখন ইতোমধ্যে তিনি নিজেই একটা সফটওয়্যার কোম্পানির মালিক। হয়তো আমরা অনেকেই মনে করব বিল গেটসের ব্রেইন প্রকৃতিগত। কিন্তু অনেক সময় ন্যাচারাল ট্যালেন্টও যে খুব আহমরি সাফল্যের জন্ম দেয় তাও নয়।বরং পরীক্ষা করে দেখা গেল খুব সাধারণ মানের মানুষেরাই অনেক বেশি সফল, কারণ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস নেই বলে অনুশীলনের বেলায় তারা কোনো ফাঁকিবাজি করে না। আগামী প্রজন্ম প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ভালো ও সৃজনশীল কাজ করুক । এটাই কাম্য তাদের কাছ থেকে। তবে সবার আগে ভালো মানুষ হওয়া জরুরি। যদি মানুষ হিসেবে ভালো না হই, তাহলে সবকিছু ভেস্তে যাবে।
লেখক : প্রভাষক- ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,
নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম